রাজধানীর জোয়ারসাহারা বাজারে সবজি কিনতে এসেছেন সিরাজুল ইসলাম। বেগুনের দাম জানতে চাইলে বিক্রেতা হাঁকলেন, ৮০ টাকা কেজি। তিনি দেখেশুনে দুটি গোল বেগুন দেখিয়ে ওজন করতে বললেন বিক্রেতাকে। দাম এলো ৩৫ টাকা।
দুটি বেগুন কেন কিনলেন—এর জবাবে সিরাজুল কালের কণ্ঠকে বললেন, ‘এখন ৮০ টাকা দিয়ে এক কেজি বেগুন কেনার সামর্থ্য আমার নেই, তাই দুটি বেগুন ওজন দিয়ে ৩৫ টাকায় কিনেছি। ’
দেশে কয়েক মাস ধরে সব ধরনের নিত্যপণের দাম বাড়ছে। মূল্যবৃদ্ধির চাপ সামাল দিতে পারছে না শ্রমজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষ। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে না পেরে সিরাজুল ইসলামের মতো কৌশল নেন কেউ কেউ। কেউ আবার খাবারে মাছ-মাংস কমিয়ে হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন। আবার দাম বেশি হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের ডিম, ডাল জোটানোও কষ্টকর হয়ে পড়েছে। এর প্রভাবে মাছ-মাংসের বাজারে ক্রেতা কমেছে বলে জানালেন বিক্রেতারা।
সিরাজুল বলেন, ‘প্রাইভেট কার চালিয়ে বেতন পাই ২০ হাজার টাকা। সংসারে স্ত্রীসহ রয়েছে আট বছরের সন্তান। তেল, ডাল, চাল, মাছ ও সবজি থেকে শুরু করে সব কিছুরই যেভাবে দাম বেড়েছে, সংসার চালাতে দিশাহারা হয়ে যাচ্ছি। খরচ বাড়লেও আমার বেতন আগের মতোই আছে। ’
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার, বাড্ডা কাঁচাবাজার ও জোয়ারসাহারা বাজার ঘুরে দেখা গেল, চাল, ডাল, আটা, ডিম, সবজি ও মাছ-মাংসসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দামই চড়া। পাঙ্গাস ও তেলাপিয়া ছাড়া ২০০ টাকা কেজির নিচে বাজারে কোনো মাছ নেই। বাজারে যেসব রুই-কাতল মাছ পাওয়া যায়, সেগুলোর ওজন দেড় কেজি থেকে তিন কেজির বেশি। ফলে রুই-কাতল মাছ কেনার সামর্থ্য অনেকের নেই। ছোট মাছের মধ্যে কাঁচকি ৪০০ টাকা ও মলা মাছ ৩৫০ টাকা কেজি। দেশি মুরগির কেজি ৫৮০ টাকা। সোনালি মুরগির কেজি ৩০০ টাকা। ব্রয়লার মুরগি ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা। গরুর মাংসের কেজি ৭০০ টাকা। খাসির মাংস ৯০০ টাকা। সব ধরনের সবজির দামও চড়া।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সংসারের ব্যয়ের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে না পেরে ক্রেতারা এখন বাজার করায় কৌশলী হওয়ার চেষ্টা করছেন। আগে যে ক্রেতা কেজি হিসেবে পেঁয়াজ, রসুন, ডাল ও সবজি কিনতেন, তাঁদের মধ্যে অনেক ক্রেতাই এখন কেজি হিসেবে পণ্য না কিনে অল্প পরিসরে কিনছেন। যাঁরা আগে বড় মাছ কিনতেন, তাঁরা তুলনামূলক কম দামে ছোট মাছ কিনছেন। গরু-খাসির মাংস না কিনে মুরগির মাংস কিনছেন।
কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের মেসার্স মা আয়েশা ব্রয়লার হাউসের ব্যবসায়ী মো. আমজাদ হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতারা মুরগির মাংস কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। ঈদের আগে দৈনিক ৩৫০ থেকে ৪০০ কেজি মুরগি বিক্রি করা যেত, এখন সর্বোচ্চ ২২০ থেকে ২৫০ কেজি মুরগি বিক্রি করতে পারছি। আগে যাঁরা ব্রয়লার পছন্দ করতেন না, তাঁরাও এখন খরচ কমাতে দেশি ও সোনালি মুরগি না কিনে ব্রয়লার কিনছেন। ’ তিনি বলেন, ‘দেশি মুরগি কেজি ৫৭০ থেকে ৫৮০ টাকা, সোনালি ৩০০ টাকা ও ব্রয়লার ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ’
বাজার খরচ বাঁচাতে অনেকেই মাছ-মাংস খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। এমন একজন রাজধানীর মধ্য বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা গৃহিণী ফিরোজা খাতুন। মধ্য বাড্ডার কাঁচাবাজারে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে সপ্তাহে এক দিন হলেও গরুর মাংস খাওয়া হতো। ঈদ চলে গেছে ২০ দিনের বেশি হবে, কিন্তু গরুর মাংস খাওয়া তো দূরের কথা, সোনালি মুরগি খাওয়ারও সাহস করতে পারছি না। কারণ বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছি না। তাই বাজার খরচ কিছুটা বাঁচাতে মাছ-মাংস কমিয়ে দিয়েছি। ’
গতকাল জোয়ারসাহারা বাজারের সবচেয়ে বড় মাংসের দোকান মনোয়ার হোসেন তালুকদার মাংসবিতানের সামনে এই প্রতিবেদক আধাঘণ্টা অপেক্ষা করেও কোনো ক্রেতার দেখা পাননি। ব্যবসায়ী মনোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মাংস বিক্রি খুবই কমে গেছে। আগে দৈনিক দু-তিনটি গরুর মাংস বিক্রি করা যেত। এখন সারা দিনে একটি গরুর মাংস বিক্রি করাও কঠিন হয়ে গেছে। ’
ঈদের পর রাজধানীর বাজারে সব ধরনের চালের দাম তিন থেকে আট টাকা বেড়েছে। গতকাল খুচরা বাজারে মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকা, মিনিকেট ৭০ টাকা, কাটারি ৭৫ টাকা, নাজিরশাইল ৭৫ টাকা।
আটা-ময়দা কেজিতে প্রায় ১০ টাকা বেড়ে খোলা আটা ৫০ টাকা, প্যাকেট (দুই কেজির) আটা ৯৬ টাকা, প্যাকেট ময়দা ৬৩ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন