এক. ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও ১৬৭ ধারায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে ২০০৩ সালের ৭ এপ্রিল একটি যুগান্তকারী রায় দেয় হাইকোর্ট। এতে ৫৪ ধারায় কাউকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাচার না করা, কাউকে নিবর্তনমূলক আটকাদেশ না দেওয়া, রিমান্ডে নির্যাতন না করা, কাচঘেরা বিশেষ কক্ষে আইনজীবী ও স্বজনদের উপস্থিতিতে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় জিজ্ঞাসাবাদ করাসহ ১৫ নির্দেশনা ছিল হাইকোর্টের। ৫৪ ও ১৬৭ ধারা সংশোধনের তাগিদ ছিল উচ্চ আদালতের। এ রায়টি পরে ২০১৬ সালের ২৫ মে আপিল বিভাগেও বহাল থাকে। রায়ের পর মানবাধিকারকর্মী ও আইনবিদরা আশা করেছিলেন, গ্রেপ্তার ও রিমান্ড নিয়ে ঔপনিবেশিক ও সংবিধানবিরোধী চর্চার অবসান ঘটবে। ১৯ বছর আগে হাইকোর্টের রায়ের পরের বাস্তবতা হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহনীর বিরুদ্ধে দুটি ধারার অপ্রয়োগ নিয়ে অভিযোগ অহরহ।
দুই. ঢাকায় অব্যাহত বায়ুদূষণ নিয়ে ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি, ওই বছরের ২৬ নভেম্বর ও ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি বেশ কিছু নির্দেশনা ছিল হাইকোর্টের। এর মধ্যে ঢাকায় নির্মাণ ও উন্নয়নকাজ চলছে এমন এলাকায় চারপাশ ঘিরে রেখে কাজ করা, নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, নির্মাণকাজ চলছে এমন এলাকায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পানি ছিটানো, ঢাকার পাশর্^বর্তী জেলাগুলোতে থাকা অবৈধ ইটভাটা বন্ধ, কালো ধোঁয়া ছড়ায় এমন যানবাহন জব্দের মতো গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু নির্দেশনা ছিল। আদেশের পর কিছুদিন এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা থাকলেও বাস্তবায়নে সেই গতি আর থাকেনি। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে না আসায় ঢাকা এখন দূষণের শীর্ষে।
মানবাধিকার, নাগরিকের মৌলিক অধিকার, জনগুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে উচ্চ আদালত প্রায়ই আদেশ, রায় ও নির্দেশনা দেয়। কিন্তু তা বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্টদের অনীহা, উদাসীনতা ও অবহেলার অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক মদদপুষ্ট প্রভাবশালীদের অপতৎপরতা, সংশ্লিষ্টদের ইতিবাচক মানসিকতার ঘাটতি, আমলাতান্ত্রিক তৎপরতা, বাস্তবায়নে বারবার সময় নেওয়াকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন আইনবিদ ও মানবাধিকারকর্মীরা।
আইন বিশেষজ্ঞদের অভিমত, গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনার বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হলে নানা ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসত, যা ভবিষ্যতের সুফল বয়ে আনত। উচ্চ আদালতের নির্দেশ পালন না করা আদালত অবমাননা ও সংবিধানের প্রতি অবজ্ঞার শামিল হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুব বেশি নেই। এসব বিষয়ে জোরালো তদারকি ও সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহির আওতায় আনতে প্রয়োজনে সুপ্রিম কোর্টে একটি সেল কিংবা সচিবালয় গঠনের তাগিদ দিয়েছেন তারা।
জনস্বার্থে গত ১৭ বছরে বায়ুদূষণ, সড়ক দুর্ঘটনারোধ, অবৈধ ইটভাটা বন্ধ, হাইড্রোলিক হর্ন ও নদীদূষণের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উচ্চ আদালতে ৩২০টি মামলা করেছে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি)। সংগঠনের সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ দেশ রূপান্তরকে জানান, ৮৫টি মামলায় জনস্বার্থ রক্ষায় রায় এসেছে। অন্তত ২২০টি জনস্বার্থের মামলায় অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ এসেছে। কিন্তু নদীদখল ও দূষণ রোধে অনেকটা অগ্রগতি হলেও অন্য নির্দেশনা বাস্তবায়নে কার্যকর গতি আগেও ছিল না, এখনো নেই। তিনি বলেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পালন করতেই হবে প্রশাসনের মধ্যে এ ধরনের ইতিবাচক মানসিকতা এখন কমে আসছে। তারা মনে করে, যে যা-ই বলুক সরকার যেভাবে বলবে, সেভাবেই হবে। এ ছাড়া ব্যক্তি ও ইস্যুর ক্ষেত্রে যেখানে প্রভাবশালী রয়েছে, সেখানে বাস্তবায়ন হয় না।’
মনজিল মোরসেদ আরও বলেন, ‘এই পরিস্থিতির জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও আমাদের সবার যেমন দায় আছে, তেমনি বিচার বিভাগেরও দায় রয়েছে। কারণ রায় কিংবা আদেশ বাস্তবায়নে অনেক সময় বিচার বিভাগের দৃঢ় ও কঠোর অবস্থানটা আমরা দেখি না। এই পরিস্থিতিটা কিন্তু দেশের জন্য ইতিবাচক হবে না।’
তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না এমন বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আদালতের আদেশ পালনে অনীহা থাকার প্রশ্নই আসে না। যাদের ওপর আদেশ আসে তারা তা মানতে বাধ্য। তবে অনেক সময় যারা আদেশ বাস্তবায়ন করতে যান, তারা কিছু আইনি বাধাসহ সমস্যার সম্মুখীন হন। সমস্যাগুলো তখন তারা আদালতকে অবহিত করেন। যে কারণে বাস্তবায়নে একটু দেরি হয়।’
ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় পরোয়ানা ছাড়া গ্রেপ্তার ও ১৬৭ ধারায় রিমান্ড নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) মো. কামরুজ্জামান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মহামান্য আদালত বিভিন্ন সময়ে আমাদের যে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন, সেগুলো আমরা অবশ্যই প্রতিপালনের জন্য বদ্ধপরিকর এবং পালন করে যাচ্ছি। যদি কোনো ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটে থাকে, সেটা বুঝে আমরা দায়ভার নিরূপণ করে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’
ঢাকার আশপাশের বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদ রক্ষায় ও দূষণরোধে ২০০৯ সালের জুন ১২টি নির্দেশনা দিয়েছিল হাইকোর্ট। নদীতীরবর্তী অবৈধ স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনা উচ্ছেদে, নদীর সীমানা নির্ধারণ করে পাকা খুঁটি বসানো, নদীর তীরে হাঁটার পথ নির্মাণ, নদীর তীরে বনায়ন ও নদীগুলো খনন করার নির্দেশনা ছিল।
সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, নদীদূষণ ও দখল রোধে হাইকোর্টের ওই নির্দেশনার পর কিছু পদক্ষেপের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই রায়ের ধারাবাহিকতায় বুড়িগঙ্গা দখল ও দূষণ ঠেকাতে বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু নির্দেশনা আসে। কিন্তু এখনো নির্দেশ বাস্তবায়ন পুরোপুরি হয়নি।
বায়ু ও নদীদূষণ নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের আইনজীবী আমাতুল করিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘অধিদপ্তরের বক্তব্য হচ্ছে, তারা যে পদক্ষেপই নেয় তা তাদের একার পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। এর জন্য সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সহযোগিতা প্রয়োজন। আমরা যতটুকু সহযোগিতা পাচ্ছি, ততটুকু করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ অবৈধ ইটভাটা বন্ধের বিষয়ে অধিদপ্তর তার ইচ্ছানুযায়ী সবকিছু করতে পারে না। যদিও আইন অধিদপ্তরকে যথেষ্ট ক্ষমতা দিয়েছে। এখানে সামগ্রিকভাবে সবার দায়িত্ব রয়েছে।’
ঢাকার শব্দদূষণের সবচেয়ে বড় কারণ গণপরিবহনে ব্যবহৃত বিকট শব্দের হাইড্রোলিক হর্ন। ২০১৭ সালের ২৩ আগস্ট পরিবেশদূষণকারী হাইড্রোলিক হর্ন জব্দ ও তা বন্ধে পদক্ষেপ নিতে পুলিশ বিভাগ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। পরে ওই বছরের ৮ অক্টোবর আরেকটি আদেশে ঢাকায় হাইড্রোলিক হর্ন রয়েছে এমন যান ও হর্ন জব্দের নির্দেশ আসে উচ্চ আদালত থেকে। কিছুদিন এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের তৎপরতা থাকলেও অগ্রগতি থমকে যায়।
২০০৯ সালের জুনে এক রায়ে ২০১০ সালের মধ্যে দেশের সব সড়কযানে গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্র স্থাপন, সব ট্রাফিক সদর দপ্তরে গতি নিয়ন্ত্রক মনিটরিং ব্যবস্থা স্থাপন করতে স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং বিআরটিএকে নির্দেশ দেয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে হাইকোর্ট সড়ক দুর্ঘটনারোধে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি নির্দেশনা দেয়। এতে মহাসড়কের পাশে ১০ মিটারের মধ্যে স্থাপনা নির্মাণের অনুমতির বিধান বাতিল, চালকদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাস নির্ধারণ, গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ সড়কে ডিভাইডার তৈরি, স্কুলের সিলেবাসে ট্রাফিক নিয়ম অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা ছিল। মহাসড়কে ছোট যান চলাচল বন্ধসহ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন সময়ে আরও কিছু নির্দেশনা ছিল উচ্চ আদালতের। কিন্তু এসব নির্দেশনার বাস্তবায়ন হয়েছে সামান্যই। এ বিষয়ে জানতে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি-বেসরকারি কর্মস্থলে যৌন হয়রানি রোধে ২০০৯ সালের ১৪ মে এক রায়ে হাইকোর্ট এসব প্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ গ্রহণের জন্য যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনসহ সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি বেশ কিছু নির্দেশনা দেয়। রায়ে বলা হয়, যত দিন পর্যন্ত জাতীয় সংসদে যৌন হয়রানি রোধ ও তা প্রতিকারের জন্য কোনো আইন প্রণয়ন করা না হয়, তত দিন পর্যন্ত সংবিধান অনুযায়ী হাইকোর্টের দেওয়া এই নির্দেশনা বাধ্যতামূলকভাবে কার্যকর হবে। কিন্তু ১৩ বছর পার হলেও গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের মর্যাদা ও পবিত্রতা রক্ষায় করা এক রিট মামলার রায়ে ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট বেশ কিছু নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ভবঘুরেদের উৎপাত বন্ধ করা, মূল বেদিতে ও বেদির পাদদেশে কোনো সমাবেশ না করা, শহীদ মিনারের পাশে একটি লাইব্রেরিসহ ভাষা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশনা ছিল রায়ে। রায়ের একযুগ পার হলেও প্রায় কোনো কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও আইন সাময়িকী ঢাকা ল রিপোর্টস’র (ডিএলআর) সম্পাদক অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘উচ্চ আদালত যখন জনগুরুত্বপূর্ণ রায় বা আদেশ দেন, সেটি বিচার-বিশ্লেষণ করেই দেন। মানবাধিকার, পরিবেশ বা জীবনরক্ষা যা-ই বলি না কেন দুই দশকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রায় ও নির্দেশনা এসেছে। এগুলো যথাযথ বাস্তবায়ন হলে দেশের পরিস্থিতি অবশ্যই পাল্টে যেত।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্দেশনা যথাযথভাবে প্রতিপালিত হচ্ছে কি না, অগ্রগতি প্রতিবেদন সংশ্লিষ্টরা দিচ্ছে কি না, এগুলো তদারকিতে সুপ্রিম কোর্টে একটি সচিবালয় বা সেল থাকা প্রয়োজন। এতে করে নির্দেশনা বাস্তবায়নে তাগিদ ও জবাবদিহি থাকবে।’
তবে সেল গঠনের বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট জনস্বার্থের মামলায় যিনি আইনজীবী তিনিই বিষয়টি তদারকি ও আদালতের নজরে আনতে পারেন। কোনো ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলে থাকলে আমাকে জানালে এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন