সরকারের কোন খাতে কতজন বিশেষায়িত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও উচ্চশিক্ষিত জনবল দরকার, এর নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। পদ পরিকল্পনাও নেই। প্রশিক্ষণ শেষে কোথায় পদায়ন করা হবে, সেবিষয়েও নেই কোনো বাধ্যবাধকতা। এসব ছাড়াই শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ কার্যক্রম চালাচ্ছে সরকার। ফলে এগুলো তেমন কাজে আসছে না। তবে এতে কর্মকর্তারা ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হচ্ছেন। অনেকেই লিয়েনে বিদেশে চাকরির সুযোগ বাগিয়ে নিচ্ছেন।
এক যুগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ৫ হাজার ১২৪ জন ক্যাডার কর্মকর্তা বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এজন্য ‘বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারকে শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পও নেওয়া হয়েছে। এর অধীনেই চলছে অপরিকল্পিত এ কর্মকাণ্ড। এতে প্রশাসনের প্রত্যাশিত মান অর্জন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। প্রকল্পটির দ্বিতীয় পর্যায় চলমান। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫৩ কোটি টাকা।
জানা যায়, পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো এবং দেশের সুশাসন নিশ্চিত করতে বিদেশে প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত একটি প্রকল্প এক যুগের বেশি সময় ধরে চলছে। ‘বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারকে শক্তিশালীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটির প্রথম ধাপ ২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত শেষ হয়েছে। ২০১৮-২০২২-এর দ্বিতীয় পর্যায় চলছে। প্রকল্পটির পৃথক ধাপ দুটি থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রথম আট বছরে আড়াই হাজার অফিসারের উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণে ২৫০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। দ্বিতীয়টির চার বছর মেয়াদে চার হাজার জনের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। যদিও করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রত্যাশিত বিদেশ প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়নি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্প ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে বিদেশে পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নেন কর্মকর্তারা।
প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে (২০০৯-২০১৭) মাস্টার্স ডিগ্রি নিয়েছেন ৫১৭ জন, ডিপ্ল্নোমা ১৪৯, সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ ১ হাজার ৪৭১ এবং রিফ্রেশার্স কোর্স করেছেন ১৯ জন। এতে মোট ২ হাজার ১৫৬ জন অফিসারের জন্য খরচ হয়েছে ২৬২ কোটি টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রশিক্ষণের জন্য ৪ হাজারের বেশি কর্মকর্তাকে টার্গেট করা হলেও প্রশিক্ষণ নিতে পেরেছেন ২ হাজার ৯৬৮ কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে মাস্টার্স ৭৫০ জন, ডিপ্ল্নোমা ১৬৮, সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ ২০০৬, রিফ্রেশার্স কোর্স ৩৭ এবং ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন ৭ জন কর্মকর্তা। করোনার কারণে অন্যরা প্রত্যাশিত প্রশিক্ষণ নিতে পারেননি।
প্রশিক্ষণসংক্রান্ত উদ্যোগে নানাবিধ ত্রুটির বিষয়টি অনুভব করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ও। জনপ্রশাসন সচিব কেএম আলী আজম যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর জন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে ক্লাস্টারভিত্তিক ভাগ করার একটা প্রক্রিয়া চলছে। এই কাজটি হয়ে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শেষে নিজ নিজ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যাবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত কাজ করছে। আশা করি, ভালো একটি পদ্ধতি হবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কর্মজীবন পরিকল্পনার (ক্যারিয়ার প্ল্যানিং) অংশ হিসাবে মন্ত্রণালয়ের ক্লাস্টার হবে, এতে যারা যেই ক্ষেত্রে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করবেন, তারা সংশ্লিষ্ট খাতে কাজ করবেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং, ক্লাস্টার পদ্ধতি চালুর বিষয়টি নিয়ে প্রায় দুই যুগ ধরে কাজ চলছে। কিন্তু এসব কাজের শেষ দেখা যায় না। এক কর্মকর্তার পর আরেক কর্মকর্তা দায়িত্বে আসেন, কমিটির পর কমিটিতে এসব আলোচনা হয়; কিন্তু কাজ আর শেষ হয় না। মন্ত্রণালয়ের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং অনেক বড় একটি উদ্যোগ। এটি বাস্তবায়ন করতে গেলে কিছু আইন ও বিধির সংশোধন আনতে হবে। তাই এ বিষয়ে উদ্যোগ থাকলেও সার্বিকভাবে কাজটি শেষ করার তেমন কোনো লক্ষণ নেই।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, করোনার কারণে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বৈদেশিক সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণে মনোনীত যুগ্মসচিব ও উপসচিবরা বিদেশ যেতে পারেননি। গত অর্থবছরে অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিবদের বিদেশ প্রশিক্ষণ বাবদ বরাদ্দ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। এখন করোনা মহামারি স্বাভাবিক হওয়ায় ফের বিদেশ প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।
‘বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারকে শক্তিশালীকরণ (২য় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালকের (পিডি) দায়িত্বে আছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. শহীদুউল্যাহ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘যারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ ও ডিগ্রি নেন, তাদের সংশ্লিষ্ট খাতে পদায়নের জন্য আমারা সুপারিশ করি। যাতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অর্জিত জ্ঞান দেশের স্বার্থে সর্বোচ্চ কাজে লাগানো যায়।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের সুপারিশ সব ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন হয় না, এটা ঠিক। কারণ আমাদের এখানে দপ্তর-সংস্থাগুলো সেভাবে ভাগ করা নেই। তাছাড়া যেখানে জরুরি ভিত্তিতে জনবলের প্রয়োজন, সেখানে তখন অফিসার নিয়োগের পদক্ষেপ নিতে হয়। এ সমস্যাগুলো কাটাতে হলে প্রশাসনের সার্বিক পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি কিছু প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করে কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বর্তমানে থাইল্যান্ডের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এআইটি) সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যায়ের ৫০ জনের একটি দল প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এই দলের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিদর্শন করতে থাইল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। প্রতিমন্ত্রী যুগান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে নতুন মাত্রায় নিতে গেলে আমাদের বৈশ্বিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ ও প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন। তাই এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সঠিক জায়গায় সঠিক ব্যক্তির পদায়ন আমাদের অগ্রাধিকার। এই চেষ্টা চালাচ্ছি। সেই সঙ্গে ক্যারিয়ার প্ল্যানিং চূড়ান্ত হলে এ কাজটা আরও সহজ হবে।
বিদেশ প্রশিক্ষণ বা উচ্চশিক্ষার মতো প্রকল্পের ক্ষেত্রে চারটি বিষয় বিবেচনা নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম। তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রশিক্ষণ বা উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেই উদ্যোগ কেন নেওয়া হচ্ছে, এর প্রাক-মূল্যায়ন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যদি একটি পর্ব সমাপ্ত হয়ে থাকে, তাহলে দেখতে হবে সেটার মূল্যায়ন হয়েছে কি না। মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরবর্তী সময়ে আরও কার্যকর পরিকল্পনা করা যায়। তৃতীয়ত, যাদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে, তাদের ক্যাটাগরি টার্গেট করে পাঠানো হচ্ছে কি না। চতুর্থত, যারা উচ্চশিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নিয়ে আসছেন, তারা দেশে এসে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগাতে পারছেন কি না। তিনি বলেন, আমাদের দেশে অনেক ক্ষেত্রে এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়েই উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে জনগণের করের টাকার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয় না।
উল্লেখ্য, বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সরকারকে শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের তৃতীয়বারের মতো সময় বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। এর মেয়াদ ২০২৫ পর্যন্ত বাড়াতে নতুন প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
সুযোগের অপব্যবহার : পরিকল্পনাহীন প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জনস্বার্থে তেমন কাজে আসছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। অভিযোগ আছে, অনেকে বিদেশে যাওয়ার সুযোগকে ব্যক্তিগত স্বার্থে অপব্যবহার করছেন। বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বিদেশে মাস্টার্স বা পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে সেখানেই লিয়েনে চাকরির ব্যবস্থা করছেন। আনুষ্ঠানিকতা সারতে দেশে এসে অনুমতি নিয়ে আবার চলে যাচ্ছেন। এমন অনেক নজির আছে। এক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে উচ্চশিক্ষা শেষে অন্তত পাঁচ বছর দেশে কাজ করার শর্ত দিচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
অন্যদিকে যারা যে ক্ষেত্রে শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ নিয়ে আসছেন তাদেরকে সেই খাতে পদায়ন করা হচ্ছে না। উদাহরণ দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ওপর মাস্টার্স করে দেশে ফেরা এক কর্মকর্তাকে প্রথমে স্থানীয় সরকার বিভাগে পদায়ন করা হয়। বর্তমানে আছেন অন্য একটি বিভাগে। কিন্তু দেশে পিপিপির পৃথক কর্তৃপক্ষ আছে। সেখানে তার মতো দক্ষ অফিসারের কাজ দেওয়া প্রয়োজন হলেও তা পাননি। এমন অনেক কর্মকর্তাই তাদের অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগাতে পারছেন না। ক্যারিয়ার প্ল্যানিং না থাকায় তদবিরনির্ভর বদলি পদায়নই এজন্য দায়ী বলে মনে করেন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন