মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ (৯০%) বাংলাদেশে ধর্মীয় সংস্কৃতি ও পর্দার বিধানের ওপর ভারতের অনুকরণে বিষোদগার বেড়েই চলেছে। পর্দা মেনে চলা ছাত্রীদের অশ্লীল কটূক্তি থেকে শুরু করে শারীরিক নির্যাতন- এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেয়ার ঘটনাও ঘটছে। এবিষয়ে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদি সরকার রহস্যজনক নীরবতা পালন করছে। ফ্যাসিবাদি প্রতিষ্ঠায় সহায়তাকারি আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরাও নীরব। অথচ, কপালে টিপ নিয়ে মন্তব্যের জের ধরে ২৪ ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চাকুরী থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গঠন করা হয়েছে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি।
টিপ কাণ্ডের রেশ শেষ না হতেই উত্তরবঙ্গের নওগাঁ জেলার মহাদেবপুরে বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে হিজাব পরার কারণে ছাত্রীদের পিটিয়েছেন একজন হিন্দু শিক্ষিকা। এমনকি প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্ত বর্মণের নির্দেশে ১৮ ছাত্রীকে মারধরের পর বিদ্যালয় থেকে বের করে দেয়ার লিখিত অভিযোগ করেছেন অভিভাবকেরা।
দৈনিক যুগান্তর অনলাইনের ৭ই এপ্রিলের খবরে বলা হয়, গত বুধবার জাতীয় সংগীত চলাকালীন বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা আমোদিনি পাল হিজাব পরে স্কুলে আসায় প্রায় ১৮ জন ছাত্রীকে মারধর করেন। এ সময় অশালীন ভাষায় গালিগালাজও করা হয় হিজাব পরিধান করা ছাত্রীদের। তাদেরকে হিজাব না পরে স্কুলে আসতে বলা হয় তখন। তার নির্দেশে ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক অষ্টম শ্রেণির তিন ছাত্রীকে মারধর করেন।
নির্যাতনের শিকার ওই স্কুলের অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী জানায়, বুধবার দুপুরে জাতীয় সংগীতের পর লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা আমোদিনি পাল ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করেন কেন হিজাব পরে স্কুলে এসেছে। এ কথা জিজ্ঞাসা করেই তিনি থামেননি। গাছের ডাল দিয়ে তাদেরকে পিটান। শিক্ষিকা তাদেরকে জানিয়ে দেন, স্কুলে কোনো পর্দা চলবে না। ঢং করে আসছো। বাসায় গিয়ে বোরখা পরে থাকো। যখন তোমরা মহাদেবপুর বাজারে যাবে তখন পর্দা করবে। স্কুলে আসলে মাথার কাপড় ফেলে আসবে। তিনি ছাত্রীদের হিজাব খুলে ফেলার জন্য টানাটানি করেন। এমনকি যারা হিজাব ছাড়া শুধু মাস্ক পড়ে এসেছিল তাদের মাস্কও খুলে দেন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, কাল থেকে যদি হিজাব ও মাস্ক পরে আসো তাহলে পিটিয়ে তোমাদের পিঠের চামড়া তুলে নেয়া হবে।
ভারতে যেভাবে হিজাবের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে, তেমনি বাংলাদেশেও এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিন্ন ধর্মের শিক্ষকেরা পরিকল্পিতভাবে একই কায়দায় হিজাব বিদ্বেষ দেখাচ্ছেন।
নওগাঁর মহাদেবপুর স্কুলেই শুধু সীমাবদ্ধ নয় এই বিদ্বেষ। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাবের বিরুদ্ধে এমন ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে অমুসলিম শিক্ষকদের। কপালে টিপ নিয়ে কথিত দালাল বুদ্ধিজীবী বিশেষণধারীরা হৈ-চৈ শুরু করলেও হিজাবের ঘটনায় তারা একেবারেই নীরব।
হিজাবের বিরুদ্ধে অমুসলিম শিক্ষকদের বিদ্বেষের সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় নজর দেওয়া যেতে পারে।
কেইস স্টাডি-০১
চলতি বছরের ১৪ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার ব্রজেন্দ্রগঞ্জ আরসি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ইংরেজি ক্লাসে বোরকা পরে আসেন এক শিক্ষার্থী। তাঁর বোরকা নিয়ে কটূক্তি করে ইংরেজি ক্লাসের শিক্ষক সেবক রঞ্জন দাস।
অশ্লীল ছবির এক অভিনেত্রীর নাম উল্লেখ করে দশম শ্রেণির সেই শিক্ষার্থীকে তার সঙ্গে তুলনা করেন সেবক রঞ্জন। হিজাবের বিরুদ্ধে ঘৃণা তার এতেও ক্ষান্ত হয়নি। সেই ছাত্রীকে পুরো একঘণ্টা দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে বাধ্য করেন তিনি।
এ ঘটনায় অভিযুক্ত ইংরেজি শিক্ষক সেবক রঞ্জন দাসের শাস্তি দাবি করে বিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেছে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা।
(গত ১৪ই মার্চ দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে এ খবর প্রকাশ করা হয়)।
কেইস স্টাডি-০২
পীর-আউলিয়াদের পুণ্যভূমি হিসেবে খ্যাত চট্টগ্রামে ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও আবেগ রয়েছে সাধারণ মানুষের । এ জেলায় সব ধর্মের লোকের সহাবস্থানের মধ্যেই ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মকর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। সেই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ে (জেবি) হিজাব নিষিদ্ধ করেছেন প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া।
স্থানীয় পত্রিকা “চট্টগ্রাম নিউজ” এর ২৯ মার্চের খবরে বলা হয়, হিজাব পরে এক ছাত্রী স্কুলে গেলে তাকে হেনস্থা ও বেত্রাঘাত করা হয়। ভুক্তভোগী ছাত্রী এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
অভিযোগে বলা হয়, সকালে হিজাব পরে বিদ্যালয়ে আসে অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী লামিয়া বিনতিহা সহ আরো ৩ শিক্ষার্থী। সকাল ১১টার দিকে এ্যাসেম্বলি শেষে ক্লাস শুরুর আগে প্রধান শিক্ষক তুষার কান্তি বড়ুয়া তাদেরকে ডেকে হিজাব খুলে ফেলার চেষ্টা করেন। এসময় অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী বিনতিহা হিজাব খুলার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানালে তাকে বেত্রাঘাত করেন প্রধান শিক্ষক। মুহূর্তেই ঘটনাটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী লামিয়া বিনতিহা জানায়, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে সে জেবি স্কুলে পড়াশুনা করছে। প্রধান শিক্ষক হিজাব পরে স্কুলে আসলে নানান ঝামেলা করেন।
কেইস স্টাডি-০৩
ভারতের স্টাইলে একটি বিদ্যালয়ে বোরকা নিষিদ্ধ করে নোটিশ দিয়েছিল নোয়াখালির সেনবাগের শেরে বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। গত ২২ মার্চ এ সংক্রান্ত নিউজ প্রকাশ করে বিবিসি বাংলা।
পরে স্থানীয় জনগণের প্রতিবাদের মুখে ইসলামের ফরজ বিধান-বিরোধী এই নোটিশ প্রত্যাহার করা হয়।
কেইস স্টাডি-০৪
দখলদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জেলা গোপালগঞ্জেও হিজাবের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান।
দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় ৩রা মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, হিজাব-বিরোধী ওই আওয়ামী লীগ নেতা ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, বিদ্যালয়ে বোরকা ও হিজাব পরে আসা চলবে না। হিজাব পরে নয়, খোলা চুলে ক্লাসে এলে তোমাদের আরও ভালো লাগবে। এ সময় তিনি নিজের হাতে একাধিক ছাত্রীর শরীর থেকে হিজাব ও চুলের স্কার্ফ খুলে টেবিলের ওপর রাখেন।
গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার জেবিপি উচ্চ বিদ্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে।
কেইস স্টাডি-০৫
চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার সাতবাড়ীয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রতন কান্তি বড়ুয়ার বিরুদ্ধেও হিজাব-বিদ্বেষী আচরণ প্রকাশের খবর বের হয়েছে।
দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার পহেলা মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ইংরেজি ক্লাসে প্রধান শিক্ষক রতন কান্তি বড়ুয়া নিজেই ক্লাস নিতে যান। এ সময় তিনি কয়েকজন ছাত্রীকে বোরকা ও নেকাব পরাবস্থায় দেখে তাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন, তোমরা বোরকা ও নেকাব কেন পরে আসছো? এই বলে তিনি তাদেরকে ক্লাসে গালমন্দ করে বলতেন থাকেন, ‘তোমাদেরকে কালো কাকের মতো দেখাচ্ছে। যদি তোমরা পরবর্তী সময় থেকে বোরকা ও নেকাব পরে ক্লাসে আস তাহলে তোমাদেরকে স্কুল থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব’।
শুধু বিদ্যালয়গুলোতেও নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও হিজাবের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে চরম কটূক্তি করেই চলেছেন কিছু শিক্ষক।
বাংলাদেশে জার্নাল এর ৩১ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রথম বর্ষের ভাইভা রুমে ঢোকার পরই ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিজাব পরা এক শিক্ষার্থীকে বলে উঠলেন, বোরকা নিকাব করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসছো কেন? মাদরাসায় পড়তে পারো না? বোরকা পরলে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার শখ হয় কেন? তারপর তাকে একপ্রকার নিকাব খুলতে বাধ্য করা হয়। আবার একটি হলের ভাইভাতে এক ম্যাডাম কটূক্তি করে বলেছিলেন, জঙ্গি দলের সাথে কানেকশন আছে নাকি?
এতো কেবল গত মার্চ মাসের খণ্ডিত চিত্র। এর বাইরেও অনেক ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ইস্যুর চাপে। ইসলাম বিদ্বেষী ফ্যাসিবাদের তাবেদার তথাকথিত গণমাধ্যম গুলো হিজাব নিয়ে বিদ্বেষের বিষয়ে কখনো নীরবতা আবার কখনো ইনিয়ে বিনিয়ে হিজাবের বিরুদ্ধে লিখে জনমত তৈরির অপচেষ্টাও চালায়।
ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার হিজাবের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। তাদের অনুসারীরা বাংলাদেশেও পরিকল্পিতভাবে হিজাব নিয়ে বিদ্বেষ ছড়ানোর অপচেষ্টায় উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন