দেশে অসংক্রামক রোগের কারণে অপরিণত মৃত্যু বাড়ছে। যত মৃত্যু হয়, এর ১০ জনের মধ্যে সাতজনই অসংক্রামক ব্যাধিতে মারা যাচ্ছেন। অর্থাৎ উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ক্যানসারসহ আরও কয়েকটি রোগে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ মারা যান। এসব রোগে ৩০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে বেশি মৃত্যু হয়। এ মৃত্যু এসডিজি বাস্তবায়নে বড় বাধা বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
রাজধানীর একটি হোটেলে বুধবার ‘প্রথম ইন্টারন্যাশনাল এনসিডিস কনফারেন্স-২০২২ বাংলাদেশ’ এর প্রথম দিনের সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা এসব বলেন।
তারা বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাদের উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস আছে-এমন তিনজনের একজন কিডনি রোগে ভুগছেন। তা তারা জানে না। দেশে ১০০ জনের মধ্যে ৫০ জনই জানে না তাদের উচ্চরক্তচাপ আছে। যাদের উচ্চরক্তচাপ আছে, তাদের অর্ধেকের বেশি জানেন না উচ্চরক্তচাপ তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ১০০ জনের মধ্যে ৭৭ জন ওষুধ খাচ্ছেন; কিন্তু তাদের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে নেই। একই অবস্থা ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রেও। সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, অসংক্রামক রোগই বাংলাদেশের জন্য ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্যঝুঁকি ও উদ্বেগের কারণ। ৬৭ শতাংশ মৃত্যুর জন্য এটি দায়ী। দেশের ২০ শতাংশ মানুষ উচ্চরক্তচাপ, ১০ শতাংশ ডায়াবেটিস ও ২০ লাখ মানুষ ক্যানসারে ভুগছে। প্রতিবছর ৫০ হাজার যোগ হয়। জীবনযাত্রার পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, স্থূলতা, তামাকের ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, অপর্যাপ্ত কায়িক পরিশ্রম, ওষুধের অপব্যবহারের কারণে অসংক্রামক রোগ বাড়ছে। দেশের আট বিভাগে ক্যানসার, কিডনি ও হৃদ্রোগের হাসপাতাল স্থাপন করা হচ্ছে। সব জেলা হাসপাতালে ১০ শয্যার ডায়ালাইসিস ও আইসিইড শয্যা স্থাপন করা হচ্ছে। উপজেলা হাসপাতালসহ দেশের সব হাসপাতালে অসংক্রমাক রোগ কর্নার করা হয়েছে।
প্রথম জাতীয় অসংক্রামক রোগ সম্মেলনের সাধারণ সম্পাদক ডা. শামীম হায়দার তালুকদার বলেন, ৩৫ বছরের ওপরে ৫০ শতাংশ মানুষের উচ্চরক্তচাপ আছে। দেশে উচ্চরক্তচাপ ডায়াবেটিস, ক্যানসারসহ কয়েকটি রোগে ৭০ শতাংশ মানুষ মারা যান। যারা অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত, তাদের চিকিৎসা নিশ্চিতের পাশাপাশি প্রতিরোধের ওপর জোর দিতে হবে। এ প্রতিরোধের জন্য আমাদের সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও অর্গানিইজিং কমিটির সায়েন্টিফিক সেক্রেটারি ডা. আলিয়া নাহিদ বলেন, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে যদি খুঁজে দেখা হয় কতজনের উচ্চরক্তচাপ আছে, সেখানে দেখা যাবে ১০০ জনের মধ্যে ৫০ জন জানে না তাদের উচ্চরক্তচাপ আছে। মানুষ যখন ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে গিয়ে সেখান থেকে প্রাথমিকভাবে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস লক্ষণ থাকার কথা শুনতে পারেন বা পরীক্ষা করে দেখেন, তখন থেকেই ওষুধ খাওয়া শুরু করে; কিন্তু চিকিৎসকের কাছে যায় না। এ কারণে দেশে অসংক্রামক ব্যাধি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত সবার মধ্যেই জ্ঞানের অভাব রয়েছে। অসুখটা হওয়ার আগেই ডায়াগনসিস করতে হবে।
তিনি বলেন, ৩০ বছর বয়সের পর থেকে প্রতিবছর একবার করে অন্তত স্ক্রিনিং করতে হবে। স্ক্রিনিংয়ের মধ্যে শরীরের ওজন, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ রক্তের বিভিন্ন পরীক্ষা করতে পারলে ভালো। শরীরের মেদ, লবণ ও চিনি বেশি পরিমাণে খাওযা, বসে বসে কাজ করা, মানসিক চাপে ভোগেন, খেলাধুলা করেন না, প্রতিদিন নিয়মিত ৩০ মিনিটের কম হাঁটাচলা করে এমন ব্যক্তিদের প্রতিবছর একবার করে স্ক্রিনিং করার পরামর্শ দেন তিনি। এসব উপসর্গ যাদের মধ্যে আছে, তারা অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে থাকেন। অসংক্রামক ব্যাধির মধ্যে উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ডিমেনশিয়া, হার্টের নানা রকম অসুখ, লিভারের সমস্যা এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকিতে থাকেন।
আলিয়া নাহিদ বলেন, আমরা গবেষণার মাধ্যমে দেখেছি, মানুষের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। মানুষ শারীরিকভাবে অসুস্থতাবোধ না করলে চিকিৎসকের কাছে যায় না। এ কারণেই অসংক্রামক ব্যাধি মানুষের ওপর ভর করছে। সাধারণ মানুষের উচিত খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা। যেমন: লবণ ও চিনি বেশি না খাওয়া এবং তেল-চর্বিজাতীয় খাবার ও তামাকপণ্য পরিহার করা। প্রচুর পরিমাণ শাকসবজি খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. হুমায়ুন কবির বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য খাতে সফলতা আছে, সীমাবদ্ধতাও আছে। অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে আমাদের সঠিক পরিকল্পনা করে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
প্রথম দিনে সকালের উদ্বোধন সেশনে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. হুমায়ুন কবির, পিওর আর্থের কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. মাহফুজুর রহমান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবদুল ওয়াদুদ চৌধুরী, সাউথ ইস্ট এশিয়া রিজিওনাল এনসিডি অ্যালায়েন্সের চেয়ারপারসন ডা. মনিকা আরোরা, ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের সভাপতি (নির্বাচিত) অধ্যাপক আখতার হোসাইন, হেলথ ইকোনমিক ইউনিটের মহাপরিচালক ডা. শাহাদাত হোসেন মাহমুদ। এ সেশনের চেয়ারম্যান ছিলেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সেক্রেটারি ডা. সারওয়ার আলী।
বৈজ্ঞানিক সেশনে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন এই সেশনের চেয়ারম্যান আইসিডিডিআর,বির সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. জামান, আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ডা. শামস এল আরেফিন, ভারতের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. অরুণ জোস, আইসিডিডিআর,বির সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. রুবানা রাকিব, অর্গানাইজিং কমিটির সায়েন্টিফিক সেক্রেটারি ডা. আলিয়া নাহিদ, ডা. আফরিন ইকবাল, ডা. আনোয়ার হোসেন প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, বুধবার দেশে প্রথম শুরু হওয়া ‘ইন্টারন্যাশনাল এনসিডিস কনফারেন্স-২০২২ বাংলাদেশ’ সম্মেলন চলবে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। নন-কমিউনিক্যাবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রাম (এনসিডিসি), বাংলাদেশ নন-কমিউনিক্যাবল ডিজিজ ফোরম (বিএনসিডিএফ), বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল রির্সাচ প্ল্যাটফরম এবং বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম, আইসিডিডিআরা,বি, ব্র্যাক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পপুলার মেডিকেল কলেজসহ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে এ সম্মেলন হচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন