পরিস্থিতি দেখে মনে হতে পারে কোনও দাগি আসামিকে জেরা করা হচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই তথ্য আদায় করতে না পেরে খিস্তিখেউড় করছেন পুলিশ কর্মকর্তা। মূলত তারা কেউই আসামি নন, বিমানবন্দরের যাত্রী। দেশের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে বেশির ভাগ যাত্রীদের সঙ্গে বাজে আচরণ করেন ইমিগ্রেশন পুলিশ সদস্যরা। বিশেষ করে প্রবাসী কর্মীদের তুই বলে সম্বোধন করা, গালি দেওয়া স্বাভাবিক চিত্র। অথচ বিদেশে গিয়ে স্যার সম্বোধন শুনে অবাক হন দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা এই মানুষগুলো।
গত কয়েক বছর ধরে যাত্রীদের অভিযোগ শুনতে বিমানবন্দরে গণশুনানির আয়োজন করছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। ঢাকায় বেবিচক চেয়ারম্যানের উপস্থিতিতে গণশুনানিতে যাত্রীদের আক্ষেপ- অভিযোগ ছিল ইমিগ্রেশন পুলিশ সদস্যদের খারাপ ব্যবহার নিয়ে। গণশুনানিতে যাত্রীরা অভিযোগ করলে বেবিচক চেয়ারম্যান ব্যবস্থা নিতে ইমিগ্রেশন পুলিশকে অনুরোধ জানালেও অবস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটেনি।
যাত্রীরা বলছেন, বিমানবন্দরের অবকাঠামোগত উন্নতি হয়েছে। বেল্টে লাগেজ দ্রুত পাওয়া যাচ্ছে। আগের চেয়ে অনেক কিছুই সুন্দরভাবে চলছে। কিন্তু বিমানবন্দরের কর্মীদের ব্যবহারের পরিবর্তন ঘটেনি। আর খারাপ ব্যবহার নিয়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ইমিগ্রেশন পুলিশকে নিয়ে। বিশেষ করে বিদেশগামী প্রবাসী কর্মীদের তুই বলা, খারাপ ব্যবহার করা, গালি দেওয়া ‘নিয়ম’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর কোনও যাত্রী যদি প্রতিবাদ করেন, তবে তাকে অহেতুক দাঁড় করিয়ে রাখা, অফলোড করাসহ নানা রকম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এমনকি বিদেশি নাগরিকরাও বাংলাদেশের বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের আচরণে হতবাক।
ইমিগ্রেশনে যাত্রীরা
জানা গেছে, দেশের তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হলো, ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রামে শাহআমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সিলেটে ওসমানি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি ফ্লাইট পরিচালিত হয় শাহজালাল বিমানবন্দরে। দিনে প্রায় ২০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। দেশের স্থল ও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলোতে ইমিগ্রেশনের কাজ করছে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ-এসবি। যদিও কাগজে-কলমে এ দায়িত্ব পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন অধিদফতরের। বিভিন্ন সময়ে ইমিগ্রেশন পুলিশ সদস্যদের খারাপ ব্যবহার, অদক্ষতা, অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে পুলিশের পরিবর্তে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের নিজস্ব জনবল দিয়ে সম্পন্ন করার সুপারিশ এসেছে। পাসপোর্ট ছাড়া বিমানের এক পাইলটের কাতারে যাওয়ার ঘটনার তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের জুনে মন্ত্রপরিষদ বিভাগের তদন্ত কমিটিও ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের নিজস্ব জনবল দিয়ে ইমিগ্রেশনের দায়িত্ব পালনের সুপারিশ করে।
ইমিগ্রেশন নিয়ে যাত্রীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইমিগ্রেশনে যাত্রীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। ইমিগ্রেশন পুলিশের ঊর্ধ্বতন জানিয়েছেন, তারা নিয়মিত তদারকি করছেন। আমরা আশা করছি, ধীরে ধীরে অভিযোগ কমে আসবে।
বাস্তবতা কি আসলেই বদলাচ্ছে? সম্প্রতি বিমানবন্দর ব্যবহার করেছেন এমন যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে বাংলা ট্রিবিউন। বেশির ভাগ যাত্রী বলেছেন, ইমিগ্রেশন পুলিশ সদস্যদের আচরণ ভালো নয়। পুলিশের পরিবর্তে অন্য কোনও সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন তারা।
কুয়েত প্রবাসী আব্দুল আলীম বলেন, ‘আমি লাইনে দাঁড়ানো, পাশে আরও একটি লাইন। কাউন্টার থেকে পুলিশ সদস্য হাত দিয়ে ইশারায় ডাকলেন। কাকে ডাকলেন বুঝতে পারছিলাম না। হুট করেই পাশে এসে একজন পুলিশ সদস্য বলছেন, ওই তোরে ডাকতেছে যাস না ক্যান। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দাঁড়ালাম, তখন সেখানে বসা পুলিশ সদস্য বলছেন, কিরে শালা, কানে শোনো না, কতবার ডাকা লাগে। পাসপোর্টে সিল দিয়ে ছুড়ে ফেরত দিলো। অথচ বিদেশে গিয়ে দেখি উল্টো চিত্র।’
ইমিগ্রেশনে যাত্রীরা
কাতারে কাজ করেন প্রবাসী মিজান রহমান। তিনি বলেন, ‘ফ্লাইট থেকে নামার পর খুব দ্রুতই করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট ভেরিফাই করে ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়াই। ৪ জন ইমিগ্রেশন অফিসার ছিলেন। আমার আগে ও পরে কেউ লাইনের ছিলেন না। তবুও এক পুলিশ সদস্য অন্য জনের কাছে যেতে বলছেন। শেষ অন্য একজন আমাকে ডাকলেন। বললেন, এদিকে আয়। আমি অবাক হয়ে গেলাম, কেন আমাকে তুই বললো।’
ওমর ফারুক সিঙ্গাপুর প্রবাসী। তিনি বলেন, ‘ইমিগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ালাম। আমাকে পাসপোর্ট আর সব কাগজপত্র দেখাতে বললেন। আমি যা যা ছিল সব কাউন্টারে রাখলাম। পুলিশ সাহেব বললেন, শালার বেটা এত দেরি করছিস কেন। এটা বলেই পেপারগুলা ছুড়ে মারলেন। সিঙ্গাপুরে গিয়ে ভয়ে ভয়ে ছিলাম এখানেও না জানি কী হয়। সিংগাপুর ইমিগ্রেশনে পুলিশ বললেন, Sir, can i have your all papers please (স্যার, আপনার কাগজগুলো দেবেন প্লিজ । আমি সব পেপার দিলাম। উনি দেখে দেখে দরকারিগুলো রেখে বাকিগুলো ফেরত দিলেন এবং বললেন, you may go now sir (আপনি এখন যেতে পারেন স্যার) ।’
নিজের অভিজ্ঞতা জানালেন জে আলম মোহাম্মদ। তিনি বলেন, ‘ভোরে কাতার এয়ারওয়েজের ফ্লাইটে ঢাকায় আসি। তখন করোনার কারণে যাত্রী অনেক কম ছিল। বিমান থেকে নামার পর যাত্রীরা কোয়ারেন্টিন যাচাই এর জন্য লাইনে দাঁড়ালেন। সেখান কাজ শেষ করে আমরা ৪-৫ জন ইমিগ্রেশনের দিকে যাই। কিন্তু কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে দেখি কেউ নেই। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর একজন আনসার সদস্য এসে বললেন, আপনারা দাঁড়িয়ে কেন, ডেস্কে যান। আমি সামনে গিয়ে দেখি, ডেস্কের ভেতর দিয়ে চেয়ারের ওপরে বসে হাত-পা ছড়িয়ে তিনি ঘুমাচ্ছেন। তাকে ডাক দেওয়ায় তিনি রেগে গেলেন।’
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিতে যে মানুষগুলো সক্রিয় অবদান রাখছে, তাদের সহযোগিতা দূরে থাক, প্রাপ্য সম্মানটুকুও দেওয়া হয় না। বিমানবন্দরে এই প্রবাসী কর্মীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা হয়। অথচ তাদের জন্য বিমানবন্দরে সবার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া উচিত। কারণ অনেকে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সম্পর্কে ঠিকমতো জানেন না। শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করলে চলবে না, সেবা দেওয়ার মানসিকতা দরকার।’
এ বিষয়ে স্পেশাল ব্রাঞ্চের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ইমিগ্রেশন) মনিরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সব সময় মোটিভেশন করি, যেন কেউ যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ আচরণ না করেন। ইমিগ্রেশনে আরও আন্তরিক হতে হবে। এ বিষয়ে প্রতিনিয়ত বলা হয়। তারপরও কারও বিরুদ্ধে খারাপ ব্যবহারের অভিযোগ আসলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন