দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে আলোচিত বেসিক ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারির মামলার তদন্ত পরিচালনা করছে বলে এক রায়ে উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে করা একটি মামলায় ব্যাংকটির শান্তিনগর শাখার সাবেক ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর জামিন মঞ্জুর সংক্রান্ত রায়ে এ অভিমত এসেছে। বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গত বছরের মার্চে ওই রায় দেন। রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে।
নথিপত্র ও আইনি দিক পর্যালোচনা করে আদালত বলেছেন, বলতে দ্বিধা নেই যে, কমিশন ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে মামলার তদন্ত পরিচালনা করছে। রায়ে আদালত বলেছেন, প্রায় ছয় বছর অতিক্রান্ত হলেও কমিশন মামলার তদন্ত শেষ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কমিশনের হলফনামা থেকে দেখা যায়, কমিশন ‘ফলো দ্য মানি’, অর্থাৎ টাকার গতিপথ
শনাক্ত করতে পারেনি বলে তদন্তকাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। আদালতকে এমনটি বলেছে সংস্থাটি। মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশন এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অন মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) নির্দেশনা অনুসরণ করছে বলে দাবি করেছে। আত্মসাৎকৃত টাকার গতিপথ শনাক্ত না হওয়া পর্যন্ত কমিশনের পক্ষে মামলার তদন্তকাজ সমাপ্ত করা সম্ভব নয় মর্মে দুদকের হলফনামায় বলা হয়।
রায়ে বলা হয়, এ মামলায় তদন্তের মূল বিষয়বস্তু হওয়া উচিত, সরকারি কর্মচারী অথবা ব্যাংকার হিসেবে আসামিদের মাধ্যমে ‘অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ’ এবং ‘অপরাধমূলক অসদাচরণ’ সংঘটিত হয়েছে কিনা। সুচিন্তিত অভিমত এই যে ওই অপরাধগুলো প্রমাণে ‘ফলো দ্য মানি’, অর্থাৎ ‘আত্মসাৎকৃত অর্থের গতিপথ শনাক্তকরণ’ আদৌ কোনো অপরিহার্য বা বাধ্যতামূলক শর্ত হতে পারে না। মামলাটি মানি লন্ডারিং আইনের অধীন নয় যে অর্থের গতিপথ নির্ধারণ অপরিহার্য বা বাধ্যতামূলক। আলোচ্য মামলা তদন্তে ফলো দ্য মানি নীতি অনুসরণ করার দাবি করে মূলত তদন্তকে অহেতুক প্রলম্বিত করে আসামিদের রক্ষা করার এক ধরনের চেষ্টা কিনা, সে প্রশ্নের উদ্ভব হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক।
বর্তমান মামলায় ফৌজদারি অসদাচরণ এবং আসামিদের মাধ্যমে অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে কিনা, এটিই তদন্তের বিষয় হওয়া উচিত বলে রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। আদালত বলেছেন, কমিশন ফলো দ্য মানি নীতি অনুসরণ করে তদন্তের যে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, তাতে আদালতের বলতে কোনো সংকোচ নেই যে কমিশন বর্তমান মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে ভুল পথ অনুসরণ করেছে এবং করছে। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নিয়মনীতি ভঙ্গ, অর্থাৎ অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গ’ এবং অপরাধমূলক অসদাচরণ ঘটিয়ে এক নম্বর আসামিকে কথিত ঋণ দেওয়ার নামে তাকে টাকা আত্মসাতের সুযোগ করে দিয়েছেন কিনা, সেটিই তদন্তের মুখ্য বিষয় হওয়া উচিত।
রায়ে বলা হয়, ২০০৪ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ও ২০০৭ সালের দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা স্বয়ং একটি সম্পূর্ণ আইন ও বিধিমালা। তদন্তের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আইন ও বিধিতে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। কমিশনকে মামলা তদন্তে নিজস্ব আইন ও বিধি অনুসরণ ও প্রাধান্য দিতে হবে এবং এটাই সংগত ও বাঞ্ছনীয়। এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ অব মানি লন্ডারিংয়ের (এপিজি) নির্দেশনা নিজস্ব আইন ও বিধির ঊর্ধ্বে হতে পারে না। এ ধরনের গাইডলাইন বা নির্দেশনার আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই; অনুসরণীয় মূল্য থাকতে পারে। এ ছাড়া এ নির্দেশনা মানি লন্ডারিং মামলার ক্ষেত্রে গুরুত্ব থাকলেও ‘অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ’ বা ‘অপরাধমূলক অসদাচরণ’ অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণীয় হতে পারে না। বর্তমান মামলার ক্ষেত্রে কমিশন ‘এপিজি’-এর গাইডলাইন প্রয়োগে ভ্রান্তিতে আছে বলে আদালতের দৃঢ় ধারণা।
রায়ে আদালত বলেন, কমিশনের দায়িত্ব দুর্নীতি চিহ্নিত করা এবং অপরাধীদের আইন ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসা। আত্মসাৎকৃত সম্পদ বা অর্থ উদ্ধার কমিশনের মুখ্য কোনো কাজ নয়। সুতরাং অপরাধী ঋণগ্রহীতা অর্থের সামান্য পরিমাণ ব্যাংকে ফেরত দিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। এতে কমিশনের আত্মতুষ্ট হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এ কারণে অপরাধীর দায়মুক্তির কোনো সুযোগ নেই।
রায়ে আরও বলা হয়, বর্তমান মামলার তদন্তকাজ দীর্ঘদিনেও সমাপ্ত না হওয়ার কারণে ইতোমধ্যে ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অনেক আসামি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে জামিন লাভ করেছেন, যাতে আপিল বিভাগ কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। অবস্থা বিবেচনায় বর্তমান আসামিকে (মোহাম্মদ আলী চৌধুরী) জামিন দেওয়া সমীচীন মনে করা হচ্ছে। তাকে সংশ্লিষ্ট আদালতে পাসপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো এবং আদালতের অনুমতি ছাড়া দেশত্যাগে বারণ করা হলো। আসামি অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের সুবিধা অপব্যবহারের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট আদালত আইনের নির্ধারিত নিয়মে জামিন বাতিল করতে পারবেন।
উল্লেখ্য, বেসিক ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ৫৬টি মামলা করে দুদক, যেখানে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। ওইসব মামলায় ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামসহ আসামির সংখ্যা শতাধিক। মোহাম্মদ আলী চৌধুরীকে আসামি করে দুদকের এ মামলা হয়েছিল ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পল্টন থানায়।
আদালতে জামিন আবেদনকারীর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও আইনজীবী সগীর হোসেন। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। রায়ের অনুলিপি পেয়েছেন জানিয়ে গতকাল বুধবার আইনজীবী সগীর হোসেন বলেন, বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি মামলায় তিনি জামিন পেয়েছেন। অপর চারটিতে জামিন আবেদনে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন