ঢাকার উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জে বাংলা চলচ্চিত্রের নায়িকা রাইমা ইসলাম শিমুর দ্বিখণ্ডিত লাশ উদ্ধারের ঘটনার রহস্য উদঘাটনের দাবি করেছে পুলিশ। তদন্তকারীরা বলছেন, পারিবারিক কলহের জেরে স্বামী সাখাওয়াত আলী নোবেলই শিমুকে হত্যা করেন। রবিবার সকালে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এরপর নোবেল তাঁর বন্ধু এস এম ওয়াই আব্দুল্লাহ ফরহাদের সহায়তায় লাশ দুই খণ্ড করে বস্তায় ভরে কেরানীগঞ্জে নিয়ে ফেলেন।
গত সোমবার সকালে লাশ উদ্ধারের পর পরিচয় শনাক্ত হলে রাতেই নোবেল ও ফরহাদকে আটক করে পুলিশ। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে তাঁদের গ্রেপ্তারের কথা জানান ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার। তবে কিভাবে, কোথায় শিমুকে হত্যা করা হয়েছে—এমন কিছু প্রশ্নের জবাব মেলেনি। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যার ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে দুজনকে আদালতের নির্দেশে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
এদিকে নায়িকা শিমুর স্বজনরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে দাম্পত্য কলহের কোনো আলামত পাননি তাঁরা। এ কারণে স্বামীর হাতে নৃশংস খুনের দাবি নিয়ে কিছুটা সংশয় আছে তাঁদের মনে। আবার শিমু টেলিভিশন নাটক প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং একটি বেসরকারি টেলিভিশনে কাজ করার পাশাপাশি চলচ্চিত্রশিল্পীদের আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। হত্যায় অন্য কোনো বিষয় আছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখার দাবি করছে স্বজনরা।
গতকাল দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ঢাকার পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সরদার বলেন, পারিবারিক কলহের জের ধরে চিত্রনায়িকা শিমুকে হত্যা করেছেন তাঁর স্বামী নোবেল। এ হত্যার কাজে সহযোগিতা করেছেন নোবেলের বন্ধু ফরহাদ। শিমুকে গত ১৬ জানুয়ারি (রবিবার) সকাল ৭-৮টার মধ্যে খুন করা হতে পারে। সোমবার সকালে এলাকাবাসীর সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ কেরানীগঞ্জের হযরতপুর ইউনিয়নের কদমতলী পাকা রাস্তার ঝোপের ভেতর থেকে দুটি বস্তায় খণ্ডিত লাশ উদ্ধারের পর তদন্ত শুরু হয়।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নিহতের আঙুলের ছাপ নিয়ে পরীক্ষা করালে ভেসে আসে নায়িকা রাইমা ইসলাম শিমুর ছবিসহ নাম-ঠিকানা। তাঁর পরিবারকে খবর দিলে মিটফোর্ড হাসপাতাল মর্গে গিয়ে ভাই শহিদুল ইসলাম খোকন লাশ শনাক্ত করেন। পরে তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য মেলে। রাজধানীর গ্রিন রোডের বাসায় তল্লাশি করে আরো কিছু তথ্য মেলে। রাতেই শিমুর স্বামী ও বোনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কথা স্বীকার করেন স্বামী। পরে তাঁর বন্ধু ফরহাদকে আটক করা হয়। এ সময় লাশ গুমের কাজে ব্যবহৃত এটিএন বাংলা স্টিকার লাগানো একটি নোয়া গাড়ি পুলিশ জব্দ করে থানায় নিয়ে আসে। নিহত শিমুর বড় ভাই হারুন অর রশিদ একটি হত্যা মামলা করেছেন।
তবে নির্দিষ্ট কী কারণে, কিভাবে শিমুকে হত্যা করা হয়েছে, সে প্রশ্নের জবাব মেলেনি। এ কারণে স্বামী ও তাঁর বন্ধুকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান পুলিশ সুপার।
গতকাল বিকেলে দুজনকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম রাবেয়া বেগমের আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। আদালত দুজনের তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।
শিমুর ছোট বোন ফাতেমা নিসা বলেন, ‘পুলিশের কাছে কী প্রমাণ আছে আমরা জানি না। তবে আমরা এমন কিছু দেখিনি যে খুন হয়ে যাবে! আমি তার (নোবেল) সাথে কথা বললে বুঝতে পারব।’ নিশা জানান, রবিবার সকাল ১০টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন শিমু। সন্ধ্যা ৭টায় তাঁর এক বন্ধু ফোন করে জানান, শিমুকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর রাত ১১টায় কলাবাগান থানায় স্বামী নোবেল একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
বস্তার সুতায় মেলে যোগসূত্র
তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, শিমুর লাশ যে বস্তায় রাখা হয়েছিল, সেই বস্তা সেলাই করা সুতার মাধ্যমে সন্দেহের আওতায় আসেন তাঁর স্বামী নোবেল। একই রকমের সুতা নোবেলের গাড়িতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া গাড়িটি ধুয়ে ব্লিচিং পাউডার ছিটানোর আলামতও মেলে। এরপর মেলে যোগসূত্র।
জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে নোবেল স্বীকার করেন, রবিবার সকাল ৭টা-৮টার দিকে তিনি শিমুকে গলা টিপে হত্যা করেন। এরপর বন্ধু ফরহাদকে মোবাইল ফোনে কল করে ডেকে নেন। পরে ফরহাদ ও নোবেল পরিকল্পনা করে বাইরে থেকে বস্তা এনে শিমুর লাশ লম্বালম্বিভাবে দুটি পাটের বস্তায় ভরে প্লাস্টিকের সুতা দিয়ে সেলাই করেন। এরপর বাড়ির দারোয়ানকে নাশতা আনতে বাইরে পাঠিয়ে নিজের ব্যক্তিগত গাড়ির পেছনের আসনে শিমুর লাশ নিয়ে বেরিয়ে যান।
জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানান, রবিবার সন্ধ্যায় লাশ গুম করতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, বসিলা ব্রিজ হয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার হযরতপুর ইউনিয়নের ওই এলাকায় সড়কের পাশে ঝোপের ভেতর লাশটি ফেলে চলে যান।
শিমুর বোন ফাতেমা নিসা জানান, তাঁদের গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর জেলার সদর থানার সিআইপাড়া এলাকায়। তাঁর বাবার নাম নূর ইসলাম। তাঁর বোন শিমু ১৮ বছর আগে ফরিদপুরের কমলপুর গ্রামের নোবেলকে বিয়ে করেন। প্রেম করে তাঁদের বিয়ে হয়। তাঁদের ১৬ বছরের একটি মেয়ে ও সাত বছরের একটি ছেলে আছে।
স্বজন ও সহকর্মীরা জানান, ১৯৯৮ সালে কাজী হায়াতের ‘বর্তমান’ সিনেমায় দ্বিতীয় নায়িকা হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন শিমু। এরপর ২০০৪ সাল পর্যন্ত ২৫টি সিনেমায় তিনি দ্বিতীয় নায়িকা ছিলেন। গেল দুই বছর ধরে এফডিসিতে যাতায়াত ছিল শিমুর। শিল্পী সমিতি থেকে ভোটাধিকার হারানো ১৮৪ জন শিল্পীর মধ্যে ছিলেন তিনি। ভোটাধিকার রক্ষার বিভিন্ন আন্দোলনে তাঁকে সক্রিয় দেখা গেছে।
সহকর্মী নায়িকা সাদিয়া মির্জা বলেন, ‘শিল্পীদের আন্দোলনসহ বেশ কিছু কার্যক্রমে শিমু জড়িত ছিলেন। এ কারণে তাঁকে কেন হত্যা করা হয়েছে—তা ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন