চিরসবুজ হিসেবে বাংলাদেশের সুখ্যাতি থাকলেও আমাদের প্রাকৃতিক অরণ্য সীমিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুসারে, ২০০০ সালে বাংলাদেশে আইনি বনভূমির পরিমাণ ছিল ২৬ লাখ হেক্টর। তবে বন বিভাগের ২০০৫-০৭ সালের ন্যাশনাল ফরেস্ট অ্যান্ড ট্রি রিসোর্স অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট অনুসারে, দেশে বনভূমির পরিমাণ ১৪ লাখ হেক্টর, যা মোট ভূমির ৯.৮ শতাংশ। ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার অর্গানাইজেশনের (ফাও) হিসাবে, আমাদের বনের অবস্থা আরো খারাপ। ২০০৯ সালে বৃক্ষ আচ্ছাদিত বনভূমির পরিমাণ ছিল মাত্র ৬.৭ শতাংশ। বন বিভাগ অবশ্য ২০১৬ সালে দেশের ভূমির ১৭.৬২ শতাংশকে বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত করে। তবে বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আছে দেশের ১০ শতাংশেরও কম ভূমি।
kalerkanthoআমাদের বনের অবস্থা সন্তোষজনক না হলেও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলেই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্যারাবন, যা সুন্দরবন হিসেবে পরিচিত। খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার মধ্যে পড়েছে এই সুন্দরবন, যা বিশ্ব ঐতিহ্যও বটে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বনভূমি (৬,০১,৭০০ হেক্টর) সুন্দরবনের সৌন্দর্যই আলাদা। এখন সুন্দরবনের যে আকার, ব্রিটিশ আমলে জঙ্গল কেটে বসতি গড়ে তোলার আগে তার দ্বিগুণ ছিল। এর পরও সুন্দরবন অনবদ্য। মানুষখেকো বাঘ ও অন্যান্য বন্য প্রাণীর সুন্দরবন পৃথিবীর জন্য এক আশীর্বাদ। তবে সুন্দরবনের ওপর ক্রমাগত হামলা চলছে—এর একটি প্রাকৃতিক, আরেকটি মনুষ্যসৃষ্ট। প্রাকৃতিক হামলার মধ্যে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস অন্যতম। আর মনুষ্যসৃষ্ট হামলার মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলা চলছে চিংড়ি চাষের মাধ্যমে। ধনী দেশগুলোতে রপ্তানির জন্য উপকূলের নানা জায়গায় বাগদা চিংড়ি চাষ করতে গিয়ে দুই লাখ হেক্টরের বেশি প্যারাবন কাটা হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজারের চকরিয়া সুন্দরবন সম্পূর্ণভাবে বিলীন হয়েছে। চিংড়ি চাষের জন্যই এমনটি হয়েছে। চকরিয়া সুন্দরবন বিলীন হওয়ায় ১৯৯১ সালের জলোচ্ছ্বাসে এর ওপরের বসতি বদরখালীর অর্ধেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। সুন্দরবন অনেক মানুষকে এখনো ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে সুরক্ষা দেয়, যা আমরা সর্বশেষ দেখেছি ২০০৯ সালে, যখন আইলা আঘাত হানে সুন্দরবনের ওপর।
সুন্দরবনের পরে আমাদের সবচেয়ে বড় বনভূমি পার্বত্য চট্টগ্রাম (৩,২২,৩৩১ হেক্টর)। একসময় পাহাড়ি এ বনভূমি ছিল চোখ-জুড়ানো সৌন্দর্যের লীলাভূমি। পার্বত্য বনে অবাধে বসবাস করত পাহাড়ি ১১টি জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার ১৮৬৫ সালে অ্যাক্ট সেভেনের মাধ্যমে তাদের এবং অন্যান্য জায়গার অরণ্যচারী মানুষের সেই অধিকার কেড়ে নেয়। বস্তুত এই অ্যাক্টের মাধ্যমেই ভারতবর্ষের বনের ওপর ব্রিটিশ ক্রাউনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়। ব্রিটিশ আমলেই পার্বত্য চট্টগ্রামের ২৪ শতাংশকে সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেখানে সেগুন চাষের ভেতর দিয়ে বাণিজ্যিক বনায়নের শুরু। পরবর্তী সময়ে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, রাস্তাঘাট তৈরি, সামাজিক বনায়ন, কর্ণফুলী পেপার মিল ও বাঙালি পুনর্বাসনের ভেতর দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের বনসম্পদ নিঃশেষ হওয়ার পথে। সেখানে দাতাদের অর্থে সামাজিক বনায়নের মোড়কে যে কৃত্রিম বনায়ন হয়েছে তাতে প্রাকৃতিক বন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কক্সবাজার ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায় রাবার ও তামাক চাষ কয়েক দশক ধরে মারাত্মক বন বিনাশের আরেকটি কারণ। এর ওপর আছে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ করার জন্য পাহাড় কাটা ও বন বিনাশ। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের থাকার জায়গা করে দিতে অনেক পাহাড় ন্যাড়া করতে হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ঘর তৈরি ও রান্নার জন্যও কাটা পড়েছে বাঁশ ও বৃক্ষ। বন বিনাশের সঙ্গে বন্য প্রাণী বিলীন হচ্ছে। বিপন্ন হাতির চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছে।
kalerkanthoদেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে শালবনের অতি সামান্যই অবশিষ্ট আছে। শালবনের মধ্যে সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ও উল্লেখযোগ্য অংশ পড়েছে টাঙ্গাইলের মধুপুর এবং ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলায়। মধুপুর শালবনের ৪৫ হাজার একর এবং মুক্তগাছার ১৭ হাজার একরের একেবারেই শেষ অবস্থা। এখানকার শালবনজুড়ে সামাজিক বনায়নের নামে বিদেশি প্রজাতি একাশিয়ার কৃত্রিম বাগান, বাণিজ্যিক আনারস, কলা ও মসলার আবাদ চলছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থে কমিউনিটি ও সামাজিক বনায়ন প্রকল্প এ অঞ্চলে গত তিন দশকে বন বিনাশের সবচেয়ে বড় কারণ। এ সময়ের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী মধুপুর শালবনের নাটকীয় বিনাশ ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প সাহায্য নতুন বিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থে উপকূলে যে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে, তা-ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চিংড়ি চাষের কারণে এবং এই চিংড়ি চাষ সফল করতে অর্থ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও অন্য দাতারা।
টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলার শালবন আটিয়া বন হিসেবে পরিচিত। আটিয়া শালবন এখন ভূমিদস্যুদের কবলে। বনের ভেতর ও আশপাশে কলকারখানা, রাস্তাঘাট, বসতভিটা, বাজার, স্কুল-মাদরাসা গড়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও বনের মধ্যে ফেলা হচ্ছে শহরের ময়লা-আবর্জনা এবং সেসব পোড়ানো হচ্ছে। এতে অনেক শালগাছ মরে কাঠ হয়ে আছে। মধুপুর ও আটিয়া শালবন এলাকায় বন বিভাগ অসহায়। এখানে বনভূমিকে কৃষিজমিতে পরিণত করতে কলা, আনারস ও মসলা চাষে যাঁরা জড়িত তাঁরা প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তবে সর্বত্র বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ শোনা যায়। আর সবার সামনে যেটা ঘটেছে তা হলো, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থে পরিচালিত বনায়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে প্রাকৃতিক শালবন কেটে এখানে তৈরি করা হয়েছে একাশিয়ার বাগান, যা দশকে দশকে কেটে আবার বনায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যেই এলাকার ভূমিদস্যু ও প্রভাবশালীরা বনভূমি দখল করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন।
আমাদের করণীয়
বিশ্বব্যাপী বন বিনাশের অন্যতম কারণ শিল্পায়নের প্রয়োজনে বৃক্ষনিধন, প্রাকৃতিক বনের জায়গায় মণ্ড তৈরির জন্য বৃক্ষ চাষ, রাস্তাঘাট নির্মাণ, বাণিজ্যিক বনায়ন, রাবার চাষ, জলবিদ্যুৎ অবকাঠামো নির্মাণ, বনের আদিবাসী নিধন (আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার বেশির ভাগ আদিবাসী ইউরোপীয়দের হাতে বা বন বিনাশসহ অন্যান্য কারণে প্রাণ হারিয়েছে) ইত্যাদি। বন ও পরিবেশ বিনাশের গুরুতর সব কারণ বাংলাদেশেও দৃশ্যমান। এর পরও আমাদের যা কিছু অবশিষ্ট আছে, তা রক্ষা করতে হবে।
খানিকটা আশার কথা, এবার (২০২১) স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে ৩১ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বর যে জলবায়ু সম্মেলন হয়েছে, যা কপ-২৬ নামে পরিচিত, তাতে আমাদের প্রধানমন্ত্রীসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা ২০৩০ সালের মধ্যে বন বিনাশ থামিয়ে দেওয়ার এবং বন ও ভূমি ক্ষয়ের চাকা ঘুরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ঘোষণাপত্র ২ নভেম্বর প্রকাশ করা হলেও বাংলাদেশ এর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ৪ নভেম্বর। অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল খানিকটা ঢেঁকি গেলার মতো করে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে বলেই মনে হয়।
তবে আমাদের দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ীরা যেভাবে বনভূমি গ্রাস করে চলেছেন, যেভাবে বনায়নের নামে প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করা হচ্ছে, বনভূমির ভেতর দিয়ে যেভাবে রাস্তাঘাট করা হচ্ছে এবং বনভূমিতে যেভাবে বাণিজ্যিক আবাদ করা হচ্ছে, তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে ২০৩০ সাল নাগাদ আমরা বন বিনাশ রোধ করে দেওয়ার যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে, তা স্বপ্নই থেকে যবে। কাজেই কালবিলম্ব না করে আমাদের সরকারকে এখনই সঠিক বননীতি তৈরি করতে হবে। বিশ্বব্যাংক ও অন্য দাতাদের ব্যাপারে সতর্ক থেকেই এই নীতি তৈরি করতে হবে। বন খাতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক ও দাতাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ কী সর্বনাশ করতে পারে তার চাক্ষুষ নিদর্শন সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আমাদের এমন এক নীতি-কাঠামো-কর্মসূচি থাকতে হবে, যাতে অরণ্য ও মানুষ একত্রে অবস্থান করতে পারে। মানুষ যদি শুধু তার মুনাফার কথা ভাবে, তাহলে অবশিষ্ট বনভূমিও ধীরে ধীরে বিলীন হতে থাকবে।
লেখক : গবেষক ও সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) পরিচালক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন