৯০ ভরি সোনা ও ৫ লাখ টাকা ডাকাতির পৃথক ঘটনায় পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের আটজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে তাঁদের অভিযুক্ত করে সম্প্রতি পৃথক তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, গত বছরের ৭ জানুয়ারি এক ব্যবসায়ীর ৫৯ লাখ টাকার সোনা ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একজন সহকারী পরিচালক এস এম সাকিব হোসেন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) এমদাদুল হক, সিপাহি আমিনুল ইসলাম ও আলমগীর হোসেন এবং গাড়িচালক ইব্রাহীম শিকদার। এ ছাড়া এই ডাকাতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন আরও তিনজন।
অন্যদিকে প্রায় দুই বছর আগে রাজধানীর ওয়ারী এলাকা থেকে এক ব্যক্তিকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা ডাকাতির ঘটনায় তিন পুলিশ কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। তাঁরা হলেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) সৈয়দ রাশেদুল আলম, উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর আলম এবং ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) সোহরাব হোসেন।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ডাকাতির মামলায় ডিবির তৎকালীন দুজন এসআই অভিযুক্ত হয়েছেন কি না, সে ব্যাপারে খোঁজ নেবেন। তবে অপরাধের সঙ্গে যিনি জড়িত থাকুক, আইন অনুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
দুটি মামলাতে পুলিশ সাক্ষ্য হিসেবে প্রয়োজনীয় ভিডিও ফুটেজ, মোবাইল ফোনের কল ডিটেইলস রেকর্ডসহ (সিডিআর) অন্যান্য সাক্ষ্য প্রমাণ জব্দ করেছে।
অবশ্য দুটি মামলায় আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতের কাছে লিখিতভাবে দাবি করেন, আসামিরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত নন।
কীভাবে ৫৯ লাখ টাকার সোনা ডাকাতি
আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, মানিকগঞ্জের সিদ্দিকুর রহমান পেশায় রড সিমেন্টের ব্যবসায়ী। সিঙ্গাইরে তিনি ব্যবসা করেন। তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার আওলাদ হোসেনের সোনার দোকান রয়েছে। সেখানে সিদ্দিকুরের বিনিয়োগ আছে। তিনি আওলাদের জন্য তাঁতীবাজারের মেসার্স শোভা বলিয়ন নামের দোকান থেকে বেশ কয়েকবার সোনা কিনেছেন। সে সূত্রে দোকানের কর্মী রতন কুমার সেন বিষয়টি ভালোভাবে জানতেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, শোভা বলিয়নের মালিক সুমনের সঙ্গে রতনের মনোমালিন্য হয়। পরে রতন পাশের সোনা ব্যবসায়ী জীবন পালকে (অভিযুক্ত আসামি) সিদ্দিকুরের সোনা কেনার বিষয়টি জানান। এরপর তাঁরা ডাকাতির পরিকল্পনা করেন। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান, ওই দোকানে সোনা কিনতে আসবেন, তা মুঠোফোনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পুলিশ সুপার এস এম সাকিবকে জানান রতন। এরপর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সাকিব সিপাহি আমিনুল ও আলমগীর এবং গাড়িচালক ইব্রাহীম শিকদার নিয়ে সরকারি গাড়িতে করে বাবুবাজারে আসেন। তখন সাকিব গাড়ি থেকে নেমে যান। এরপর গাড়িটি যখন জিন্দাবাহার পার্কের সামনে আসে তখন আমিনুল গাড়ি থেকে নেমে যান।
পরে আমিনুলের কথামতো ইব্রাহীম গাড়িটি জিন্দাবাহারের উত্তর পাশে রাখেন। আর রতন ও জীবন শোভা বলিয়নের আশপাশে অপেক্ষা করতে থাকেন। সিদ্দিকুর সন্ধ্যা পৌন সাতটার দিকে দোকানে আসেন এবং ৯০ ভরি সোনা কেনেন। তখন দোকানের কর্মচারী রতন সেন পাশে থাকা জীবন পালকে ইশারায় সিদ্দিকুর রহমানকে দেখিয়ে দেন। তখন থেকে জীবন পাল সিদ্দিকুর রহমানকে অনুসরণ করতে থাকেন। সিদ্দিকুর প্রসন্ন পোদ্দার লেন হয়ে জিন্দাবাহার পার্কের দিকে রওনা হন। তিনি যখন জিন্দাবাহার পার্কের কাছাকাছি আসেন, তখন তাঁর পথরোধ করেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা সাকিব ও আমিনুল। সাকিব নিজের হাতে থাকা ওয়্যারলেস সেটটি দেখিয়ে ব্যবসায়ী সিদ্দিকুরকে বলেছিলেন, ‘আমরা পুলিশের লোক। সামনের গাড়িতে ওঠ। পালানোর চেষ্টা করলে গুলি করব।’ জোর করে সিদ্দিকুরকে গাড়িতে ওঠানো হয়। এরপর সাকিব গাড়ি মোছার গামছা দিয়ে ব্যবসায়ী সিদ্দিকের চোখ বেঁধে ফেলেন এবং হাতকড়া পরান।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, সিদ্দিকুরকে গাড়িতে তোলার পর গাড়িটি মুন্সিগঞ্জের নিমতলার দিকে রওনা হয়। পরে ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেছিলেন, ‘স্যার, আমার কাছে যা আছে, তা আমি দিচ্ছি। আমাকে মারবেন না।’ তখন সাকিব হোসেন সিদ্দিকের কাছে থাকা ৯০ ভরি সোনা, ১৯ হাজার টাকা, ২টি পুরোনো মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন। গাড়িটি যখন কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগার পার হয়, তখন সিদ্দিকের হাতকড়া খুলে দেওয়া হয়। পরে চোখ বাঁধা অবস্থায় তাঁকে গাড়ির পেছনে নিয়ে যায় ও একপর্যায়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। তখন আসামিরা বলেছিলেন, ‘যদি পেছন দিকে তাকাস, তো গুলি করে দেব।’
তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে। সংগ্রহ করা হয় ঘটনাস্থলের আশপাশের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার (সিসি ক্যামেরা) ভিডিও ফুটেজ। আসামি সাকিবের কাছ থেকে ৩৩ লাখ টাকা মূল্যের ৫৮৩ গ্রাম সোনা উদ্ধার করা হয়। জীবন পালের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ডাকাতির ৬ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ডাকাতির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে সাকিব হোসেনসহ অভিযুক্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
মামলাটি তদন্ত করেন কোতোয়ালি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রুবেল মল্লিক।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পাঁচ সদস্য ও সোনার দোকানের দুই কর্মচারী ছাড়া অপর আসামি হলেন হারুন মুনশি। তিনি রতন ও জীবনের সহযোগী।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আদালতকে জানান, তাঁরা ষড়যন্ত্রের শিকার। এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত নন।
আসামি ইব্রাহীমের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মক্কেল নির্দোষ।
‘যদি পেছন দিকে তাকাস, তো গুলি করে দেব’
র্যাব পরিচয়ে ডাকাতি করে পুলিশসহ অন্যরা
মামলার কাগজপত্রের তথ্য বলছে, মাদারীপুরের শফিউল আলম আজাদ পুরান ঢাকার ওয়ারীর ভজহরি সাহা স্ট্রিটে ভাড়া থাকেন। তাঁর মামা সজীব হোসেন সিঙ্গাপুরপ্রবাসী। দুই বছর আগে (২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর) মাদারীপুরে মামার বাড়ি নির্মাণের জন্য শফিউল ৫ লাখ টাকা নিয়ে রওনা হন। তিনি এবং তাঁর ভাগনে মাহমুদুল, বন্ধু সিয়াম উদ্দিন যখন টিপু সুলতান রোডে আসেন, তখন তাঁদের সামনে একটি মাইক্রোবাস থামে। গাড়িতে থাকা পাঁচ থেকে ছয়জন ব্যক্তি নিজেদের র্যাব পরিচয় দিয়ে জোর করে শফিউল আলমসহ অন্যদের গাড়িতে তুলে নেয়। যিনি গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তাঁর পাশে বসা লোকটির কাছে পিস্তল ছিল। গাড়িতে তোলার পর তাঁদের মারধর করা হয়। গাড়িটি পোস্তগোলা ব্রিজ হয়ে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের শ্রীনগরে যাওয়ার পর কালো কাপড় দিয়ে তাঁদের চোখ বাঁধা হয়। পরে তাঁদের নানা বিষয় প্রশ্ন করে ও আবারও মারধর করা হয়। শফিউলের কাছে থাকা পাঁচ লাখ টাকা, এটিএম কার্ড ছিনিয়ে নেয়। একপর্যায়ে তাঁদের নিমতলা এলাকায় গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে চলে যান আসামিরা।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, সেদিন মাইক্রোবাসে অবস্থান করেন আসামি এসআই সৈয়দ রাশেদুল আলম, এসআই জাহাঙ্গীর আলম, সোহরাব হোসেন ও তাঁদের সহযোগী রিপন গাজী। রাশেদুল আলম নিজেকে র্যাব পরিচয় দেন।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, র্যাব পরিচয়ে পাঁচ লাখ টাকা ডাকাতির ঘটনায় জড়িত অভিযুক্ত সোহরাব, জাহাঙ্গীর ঢাকা জেলা ডিবিতে কর্মরত ছিলেন। তখন তিনি বিভিন্ন রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। জাহাঙ্গীর ও সোহরাবের বিরুদ্ধে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা রয়েছে। আসামি রাসেল আহমেদ মোল্লা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাঁর জবানবন্দিতে পুলিশের এএসআই সোহরাব, এসআই জাহাঙ্গীর, এসআই রাশেদের নাম উঠে আসে।
যোগাযোগ করা হলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওয়ারী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে যা পেয়েছেন, সেটি আদালতকে তিনি প্রতিবেদন দিয়ে জানিয়েছেন।
অভিযোগপত্রভুক্ত অন্য আসামিরা হলেন পুলিশ সদস্যদের সহযোগী রিপন গাজী, মুক্তার হোসেন, আশিক ইকবাল খান, রাসেল আহম্মেদ ও শরিফুল ইসলাম।
অবশ্য এসআই জাহাঙ্গীর আলমের আইনজীবী আকরাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মক্কেল অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন