নিরাপদ সড়ক চেয়ে চলমান আন্দোলনে মঙ্গলবার রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় সড়কে চলাচলকারী পরিবহনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও চালকদের লাইসেন্স দেখেন তারা। শিক্ষার্থীরা জানান, যাদের লাইসেন্স নেই তাদের প্রায় সবাই প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং পুলিশ। পরে তাদের মামলা দিয়ে ছাড়া হয়েছে।
তারা বলেন, বাসে হাফ ভাড়ার ঘোষণা এলেও আন্দোলনের মাঠ ছাড়ছেন না শিক্ষার্থীরা। বরং সড়ক নিরাপদ করতে আরও কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কার্যকর পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা পর্যন্ত তারা সড়ক ছাড়বেন না।
জ্বালানি তেলের ২৩ শতাংশ দাম বৃদ্ধির পর গণপরিবহনে ২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়ানো হয়। এ অবস্থায় কিছুদিন ধরে হাফ ভাড়া চেয়ে রাজধানীতে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা।। এই পরিস্থিতির মধ্যে গত বুধবার গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নিহত হন নটর ডেম কলেজছাত্র নাঈম হাসান। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালের পর নয় দফা দাবিতে ফের সড়কে নেমে আসেন।
এরই মধ্যে সোমবার রাতে রামপুরায় অনাবিল পরিবহনের চাপায় প্রাণ হারান এসএসসি পরীক্ষার্থী মাঈনুদ্দিন দুর্জয়। এ ঘটনার জেরে আরও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার তারা দিনভর ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
শিক্ষার্থীরা ‘ছাত্র সমাজ জেগেছে, উই ওয়ান্ট জাস্টিস, সড়কে হত্যাকারীদের বিচার চাই’- এমন স্লোগানে উত্তাল করে তোলেন। সকাল ১০টা থেকে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, ইম্পিরিয়াল কলেজ, ন্যাশনাল আইডিয়াল ও রাজধানী আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রগতি সরণিতে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা রামপুরা ব্রিজ এলাকায় সড়কে বসে পড়েন। এতে সড়কের দুপাশে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
তবে শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন যানবাহনের চালকদের সঙ্গে কথা বলে যাদের জরুরি প্রয়োজন রয়েছে তাদের ছেড়ে দেন। দুপুরের পর সড়ক মোটামুটি ছেড়ে দেওয়া হলেও শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নিয়ে চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করতে থাকেন।
বিকেলে রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে রয়েছে। আপাতত যান চলাচল শুরু হয়েছে।
ইম্পিরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার বাপ্পি বলেন, কোনো শিক্ষার্থী মারা গেলেই আমাদের নতুন নতুন আশ্বাস দেওয়া হয়। বলা হয় ফুটওভার ব্রিজ করবে। আমরা এখন আর ফুটওভার ব্রিজ চাই না। আমরা হত্যাকারীদের বিচার চাই।
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ সরকার বলেন, হাফ ভাড়া মেনে নেয়া হলেও আমরা সড়ক থেকে সরব না। আমরা প্রাণের নিশ্চয়তা চাই। ঢাকার সড়ক মানুষ চলাচলের অনুপযোগী। এই ব্যবস্থা সংস্কার না হওয়া পর্যন্ত আমরা সড়কে থাকব।
মতিঝিল এলাকা নিরাপদ সড়কের দাবিতে মতিঝিল শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেন শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল সেন্ট্রাল হাইস্কুলের ছাত্ররা শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেন।
এ সময় তারা ‘জেগেছে জেগেছে, ছাত্র সমাজ জেগেছে’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আমার ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’- স্লোগান দেন। সড়কে তাদের অবস্থানের কারণে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয় ওই এলাকায়।
একই দাবিতে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরে সড়ক অবরোধ করেছেন মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর গভর্নমেন্ট কলেজ, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ, ধানমন্ডি আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ধানমন্ডি-২৭ রাপা প্লাজার সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় পুলিশ ও ট্রাফিক সদস্যদের আশপাশে অবস্থান করতে দেখা গেছে।
লালমাটিয়া মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী শাহরিন শামস বলেন, আমাদের জন্য ঢাকার সড়ক মোটেও নিরাপদ নয়। শিক্ষার্থীরা নিয়মিতই মরছে এই সড়কে। নটর ডেমের শিক্ষার্থী মারা যাওয়ার পর গতকাল আরেক এসএসসি শিক্ষার্থী মারা গেল। সুষ্ঠু বিচার ও ব্যবস্থাপনা না থাকায় এমনটি হচ্ছে। সড়ক নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরব না।
একই দাবিতে মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর গার্লস কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ আশপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়কে বসে বিক্ষোভ করেন।
সহপাঠী হত্যার বিচার চেয়ে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও নীলক্ষেত এলাকায়ও বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীদের ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘নিরাপদ সড়ক চাই’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা যায়।
এর আগে বেলা পৌনে ১১টার দিকে নীলক্ষেত মোড় অবরোধের চেষ্টা করেন ঢাকা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। কিন্তু ঢাকা কলেজের শিক্ষকদের বাধার কারণে তারা দাঁড়াতে পারেননি।
পরে ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ, ধানমন্ডি আইডিয়াল কলেজসহ আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মিলিত হয়ে মিছিল শুরু করেন।
মঙ্গলবার বিকেলে রামপুরা কাঁচাবাজারের সামনে দেখা যায়, সড়কের মাঝে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীরা যানবাহনের কাগজপত্র পরীক্ষা করছেন। এ সময় এই প্রতিবেদকের মোটরসাইকেল কাগজ পরীক্ষা করেন তারা। দেখা যায়, যাদের গাড়ির কাগজপত্র ঠিক নেই তাদের পাশেই থাকা ট্রাফিক সার্জেন্টের কাছে মামলার জন্য দেওয়া হচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, প্রায় ৮০ ভাগ চালকের লাইসেন্স রয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও পুলিশদের প্রায় কারো লাইসেন্স নেই। অথচ তারাই আইন প্রয়োগ করছে।
এই আলোচনার মধ্যে ডিএমপির একটি থানার উপপরিদর্শকের গাড়ি আটকান শিক্ষার্থীরা।
দেখা যায়, ওই পুলিশ কর্মকর্তার অনেক কাগজই ঠিক নেই। পরে তাকে ছয় হাজা টাকা মামলা দেওয়া হয়।
রামপুরার একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পিয়াস সাহা বলেন, আমরা দেখছি যাদের লাইসেন্স নেই তারা সবাই পুলিশ ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তারা কাউকে তোয়াক্কা করে না। একটা দেশ এভাবে চলে কী করে?
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন