বিস্তৃত স্থানজুড়ে কারমাইকেল কলেজ। কলেজটির বিভিন্ন স্থানে গোল হয়ে গ্রুপ অধ্যয়ন করেন শিক্ষার্থীরা। এই অধ্যয়ন শ্রেণি পাঠের জন্য নয়। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিসিএস’র। বিষয়ভিত্তিক পড়ালেখা ফেলে তারা মেতেছেন বিসিএস’র জন্য। রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় গ্রন্থাগারের চিত্রও একই। লাইব্রেরি খোলার আগেই নিয়োগ পরীক্ষার্থীরা ব্যাগ রেখে দেন সিরিয়াল। সাধারণ একজন পাঠক চাইলেও একটু পড়বার জো পান না লাইব্রেরিতে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা ব্যয় করছেন। উদ্দেশ্য বিসিএসসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা।
বিসিএস বা সরকারি চাকরির জন্য মরিয়া চেষ্টা করেন উচ্চ শিক্ষা অর্জন করা প্রায় সব শিক্ষার্থী। শিক্ষাবিদরা বলছেন এতে স্ব স্ব বিভাগের অর্জিত জ্ঞান এবং দক্ষতা কাজে লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছেন তারা। একইসঙ্গে শুধু বিসিএস বা সরকারি চাকরির লক্ষ্য নিয়ে দিনের পর দিন চেষ্টা করার পর ব্যর্থ হয়ে অনেকে হতাশায় ভুগেন। তারা না হতে পারেন উদ্যোক্তা, না চাকরিজীবী।
আজ শুক্রবার অনুষ্ঠিত হবে ৪৩তম বিসিএস’র প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। যাতে অংশ নিতে আবেদন করেছেন ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৯০ জন। এই বিসিএসে ১ হাজার ৮১৪ জন নিয়োগ পাবেন।
প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যায়ন শেষে সহকারী কমিশনার হিসেবে কর্মরত একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন আমলারা। তাই এখানে আসতেই চাইবে। আমাদের দেশের মেধাবীরাই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়। সামাজিকভাবে যারা দেশে থাকতে চান তাদের দরকার একটা সম্মানজনক চাকরি। দেশের মানুষের জন্য কাজ করার জন্য এর থেকে ভালো কিছু হয় না। সরকারি চাকরি আগের মতো নাই। এখন চাকরিতে বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন করা হয়। অনেকে মনে করেন সরকারি চাকরি মানেই টাকা দিয়ে নিতে হয়। কিন্তু আমি শতভাগ মেধা দিয়েই চাকরিতে প্রবেশ করেছি।
প্রকৌশলী থেকে বিসিএস। সরকারের অর্থ অপচয় হচ্ছে কিনা এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি যদি দেশের বাইরে চলে যাই তাহলে তো পুরো অর্থটাই অপচয়। আমি আমার সেক্টরে কাজের সুযোগ কতোটা পাচ্ছি এটা বুঝতে হবে। ধরেন এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বছরে ১০০ জন দর্শন থেকে পাস করলো। কিন্তু দেশে কতোজন দার্শনিক আমাদের বের হচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইউসুফ আলম অনার্স শেষ করেন। এরপর ফ্রান্সে মাস্টার্স শেষ করে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ডক্টরেট করছেন। তিনি বলেন, আমার পরিবারের সবাই সরকারি চাকরিজীবী। বিসিএস অবশ্যই সম্মানের চাকরি কিন্তু আমি ফার্মেসি পড়ে এত বছরের জ্ঞানটা বাস্তবায়ন করতে পারবো না। তাই ভাবলাম এই বিষয়টা নিয়েই পড়ালেখা করি। তাই চলে আসলাম।
৩৫তম বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিসিএস হচ্ছে বাংলাদেশের চাকরির ক্ষেত্রে একটা ট্রেডমার্ক। আমরা সবাই প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। এটা সবার কাছেই একটা সম্মান। যারা মেধাবী তারা মেডিকেলে কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যায়। অন্যরা ঠিকভাবে মূল্যায়িত হয় না। অনেক সময় তারা ভালো বেতন পেলেও সম্মানটা সেইভাবে মেলে না। এইজন্য বিসিএস’র দিকে ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিসিএস প্রত্যাশী শিক্ষার্থী আরাফ আহমেদ বলেন, বিসিএস সরকারি প্রথম শ্রেণির চাকরি। প্রমোশন, সম্মানের দিক থেকে অন্যান্য চাকরি থেকে একটু এগিয়ে। আর টেকনিক্যাল কোনো বিষয়ে পড়িনি তাই মনে হচ্ছে আপাতত সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করাই ভালো হবে। বিসিএস’র পাশাপাশি অন্যান্য সরকারি চাকরিতেও চেষ্টা করছি। বেসরকারি চাকরিতে টেকনিক্যাল বিষয় হলে ভালো করা যায়, অন্যথায় প্রেসার একটু বেশি থাকে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সরকারি চাকরি ছাড়া অন্য চাকরির স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা কম মনে হয়। যদিও ভাই এইগুলো শুনতে আসলে গতানুগতিক মনে হয় কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এটাই সত্য।
বলা হয়ে থাকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিসিএস’এ অনেকটাই পিছিয়ে। অধিকাংশ শিক্ষার্থী পরীক্ষাটাও দেন না। জানতে চাইলে সিমি জাহান সোমা বলেন, আমাদের লেখাপড়াটা যেহেতু প্রাকটিক্যাল কেন্দ্রিক। আর আমাদের পাবলিকের মতো না আমরা পছন্দের বিষয় নিয়েই লেখাপড়া করতে আসি সিংহভাগ। তাই আমাদের পছন্দের বিষয়ে চাকরিতে প্রবেশ করি। পাবলিকের শিক্ষার্থীরা বিষয় পায় আর আমরা পছন্দ করি। যেমন ধরেন ইসলামের ইতিহাস বা বাংলা এসব বিষয়ে আসলে আমার ধারণা ৯৯ শতাংশই পড়বার সুযোগ পায়, পছন্দের বিষয় না। আরেকটা বিষয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে আমার এত লেখাপড়া করার আসলে কোনো ইচ্ছা নাই।
বিসিএস প্রত্যাশী পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আনিসুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে বেসরকারি খাতে নতুন অনেক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলেও সুযোগ-সুবিধা কম। এমনকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেতন বাড়েনি। অন্যদিকে সরকারি চাকরির বেতন স্কেল বৃদ্ধি পাওয়ায় একজন সরকারি চাকরিজীবী যে বেতন পান তা দিয়ে সৎভাবে জীবনযাপন করা সম্ভব। তাছাড়া আমাদের সমাজে একটা অসুস্থ মানসিকতা বিরাজমান তা হলো সরকারি চাকরিজীবীকে অন্য পেশার তুলনায় একটু মর্যাদার সঙ্গে দেখা। আবার বিসিএস ক্যাডার এবং অন্য সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে প্রমোশন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তিতে বিরাট বৈষম্য রয়েছে। তাই সকল দিক বিবেচনা করে বিসিএসকে বেছে নিয়েছি।
বাংলাদেশ কর্ম কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী ২৩ থেকে ২৫ বছরের পরীক্ষার্থীরাই অধিকাংশ সুপারিশপ্রাপ্ত হন, ৪২.১১ শতাংশ শিক্ষার্থী। ২৫-২৭ বছর বয়সীরা হন ৩২.৭১ শতাংশ। আর সংখ্যা ও সুপারিশপ্রাপ্ত হবার ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছেন পুরুষরা। ৩৮তম বিসিএস’র তথ্যানুযায়ী অংশগ্রহণ করেন ২১৯৮৭৩ জন পুরুষ (৬৩.৪৭ শতাংশ) ও ১২৬৫৬৭ জন নারী (৩৫.৫৩ শতাংশ)। প্রিলিমিনারি টেস্টে উত্তীর্ণ হন পুরুষ ১৩৪৮১ (৮২.৭৮ শতাংশ) ও ২৮০৫ (১৭.২২ শতাংশ) পরীক্ষার্থী। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ৭৯৮৫ (৮০.৯৭ শতাংশ) পুরুষ ও নারী ১৮৭৭ (১৯.০৩ শতাংশ) জন। সুপারিশপ্রাপ্ত হন ১৬১১ (৭৩.০৯ শতাংশ) পুরুষ ও ৫৯৩ (২৬.৯১ শতাংশ) নারী। ৩৫, ৩৬ ও ৩৭তম বিসিএস বিশ্লেষণ করেও দেখা যায় ঢের এগিয়ে রয়েছেন পুরুষরা।
আবার বিবাহিতদের থেকে এগিয়ে রয়েছেন অবিবাহিত চাকরি প্রত্যাশীরা। ৩৫তম থেকে ৩৯তম বিসিএস বিশ্লেষণ করে দেখা যায় অবিবাহিতরা সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন যথাক্রমে ৮৩ দশমিক ৭২, ৮৫ দশমিক ৯৭, ৮৪ দশমিক ৬২, ৮৪ দশমিক ০৩, ৫৬ দশমিক ১২ শতাংশ।
৩৫, ৩৬, ৩৭, ৩৮ ও ৩৯তম (বিশেষ) সুযোগ পান যথাক্রমে ২১৮১, ২৩২৩, ১৩১৩, ২২০৪ ও ৬৭৯২ জন। মেধাক্রমে ১৪৭২, ১৫২০, ৮৪৪, ১৪২৩ ও ৪৫৫৯ জন। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ১৯৮, ২০৯, ১৩৪, ২২৬ ও ৫৩১ জন। মহিলা কোটায় যথাক্রমে ২০৫, ২১০, ১২১, ২১১ ও ৬৭৯ জন। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটায় ২১, ১৬, ১৮, ৩৩ ও ৪৩ জন। জেলা কোটায় ২৮২, ৩৬৫, ১৯২, ৩১০ ও ৯৭৫ জন ও প্রতিবন্ধী কোটায় ৩, ৩, ৪, ১ ও ৫ জন। উত্তীর্ণ হবার পর যোগদানের জন্য সময় লেগেছে ৩৫তম ১ বছর ১০ মাস ২৪ দিন। ৩৬তম ২ বছর ৪ মাস ১৬ দিন। ৩৭তম ২ বছর ৩ মাস ১৩ দিন। ৩৮তম ৩ বছর ১০ দিন ও ৩৯তম ১ বছর ২২ দিন।
বিসিএস-এ সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েও যোগদান করেননি আলিফ চৌধুরী। তিনি পাড়ি দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। তিনি বলেন, বিসিএস নিয়ে যা হয় তা এক কথায় অমানবিক। একজন শিক্ষার্থী যে কিনা প্রকৌশল বিদ্যায় পারদর্শী তাকে আমরা ইতিহাস দিয়ে মূল্যায়ন করছি। শুধু তাই নয় এই ইতিহাসের পারদর্শিতা দিয়ে দেশের সবথেকে বড় চাকরি দিচ্ছি। কেন এমনটা হবে? বিসিএস -এ ভাগ আনা জরুরি। বিষয়ভিত্তিক মূল্যায়ন করেই তাকে মূল্যায়িত করা হোক। আর যে শিক্ষার্থী দিন রাত এক করে পড়ালেখায় ডুব দিচ্ছে। তার ক্যাম্পাসের কনসার্টে কে গাইলো? তার ক্যাম্পাসের রাজনীতি কীভাবে চলছে কিংবা শিক্ষাজীবনে আড্ডা না দিয়ে বই নিয়ে ডুব দিলো। তার কাছ থেকেই বা দেশ কতোটা আশা করতে পারে। তিনি আরও বলেন, আমি বলছি না সবাই এই কাতারে। আড্ডা, রাজনীতি কিংবা কনসার্টে গান শুনেও অনেকেই বিসিএস এ উত্তীর্ণ হন। কিন্তু বইয়ে ডুব দিয়ে আরও একটা বড় ক্ষতি হচ্ছে। সবাই তো আর বিসিএস বাগিয়ে নিতে পারছেন না। তারা যখন অন্য পেশায় জড়াচ্ছেন তখন তার বয়স ৩০ এর অধিক। বাস্তবে হয়তো ৩২/৩৩। এই বয়সে দীর্ঘদিন বইয়ে ডুব দেয়া মানুষটার কাছে থেকে কতোখানি সৃজনশীলতা আশা করা যেতে পারে?
বিসিএস’র জন্য প্রস্তুতি এবং শেষ বয়স পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছেন মফিজুল ইসলাম। ব্যর্থ হয়ে তিনি এখন বাবার ফার্মেসির দোকানে বসছেন। নীলফামারীর বাসিন্দা মফিজুল বলেন, আমাদের পারিবারিক ওষুধের দোকান। বড় ভাই এইচএসসি পাস করার পরই ব্যবসায় নাম লেখান। শূন্য হাতে শুরু করে তিনি ১৫ বছরে তিন কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। আর আমি লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থেকে এখন শূন্য হাতে ৩০ পেরিয়ে ব্যবসায় নাম লিখিয়েছি। বিসিএস’র প্রস্তুতি নিয়ে রীতিমতো আমার জীবনটাই ব্যর্থ হলো।
দীর্ঘদিন উচ্চ শিক্ষা নিয়ে কাজ করছেন ড. মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি উচ্চ শিক্ষা নিয়ে করেছেন পিএইচডি ডিগ্রি। তিনি বলেন, বিসিএস-এ কিছু পরিবর্তন আনা সময়ের দাবি। বিসিএস পরীক্ষা যাতে প্রকৌশল কিংবা কৃষি নিয়ে যারা অধ্যয়ন করেন সকলেই যাতে অংশগ্রহণ করতে পারেন সমভাবে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এসব আরও কিছু বিষয় যুক্ত করা প্রয়োজন। উচ্চ শিক্ষায় যদি এ বিষয়গুলো যুক্ত করা হয় তবে কারও একক থাকে না। এতে যারা জেনারেল থেকে পড়ালেখা করছেন তারা প্রাথমিকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আইসিটির কিছু বিষয় ছিল যেগুলো সময়ের দাবিতে যুক্ত করা হয়েছে। সে রকমই বিসিএস’এও এগুলো যুক্ত করলে সময়ের চাহিদা মেটাবে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় বিসিএস হচ্ছে সম্মান, অর্থ, জব সিকিউরিটি একটা মিশেল। আবার অনেক সময় টাকাই শুধু বিষয় থাকে না, বিসিএস একটা আলাদা পরিচয় তৈরি করে। তবে কেন শুধু বিসিএস দিয়েই এই পর্যায়ে যেতে হবে। ভিন্ন কোনো পন্থা দিয়ে বিষয়ভিত্তিক লেখাপড়া দিয়েও তাদের সেই পর্যায়ে নেয়া যেতে পারে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন