মেয়াদকাল ৩৫ বছর হলেও সাত বছরেই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে ২০টি ডেমু ট্রেনের ১৬টি। বছরের পর বছর ‘আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র)’ রেখে নানা চেষ্টার পরও এগুলোকে সচল করা যাচ্ছে না-এমন অভিমত সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, বাকি চারটির অবস্থায় নড়বড়ে। যেকোনো সময়ই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। চালু হওয়ার দুই বছর না যেতেই চীন থেকে আনা ‘অত্যাধুনিক’ ডেমু ট্রেনগুলোতে নানা সমস্যা দেখা দেয়। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে সব ডেমু।
সংশ্লিষ্টদের আরও অভিমত, ক্রয় থেকে পরিচালনা পর্যন্ত অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ডেমু কেনার আগে অন্তত ৩০ জন কর্মকর্তা চীনে দুই মাস অবস্থান করেন। কিন্তু তারা বাংলাদেশের উপযোগী ট্রেন নির্মাণে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দেননি চীনের দায়িত্বপ্রাপ্তদের। ফলে ৬৪৫ কোটি টাকা কেনা ডেমু এখন, ধ্বংসের শেষ প্রান্তে। এই ঘটনার জন্য যারা দায়ী, তাদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন যুগান্তরকে বলেন, রেলে যে কোনো প্রকল্প নিতে হলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকতে হয়। এ প্রকল্প গ্রহণে এটি ছিল না। আমরা এ ডেমু নিয়ে বেশ ঝামেলায় রয়েছি। পুরো ট্রেন চীনের নিজস্ব সফটওয়্যার দ্বারা পরিবেষ্টিত। আমাদের চেষ্টার কমতি নেই, কিন্তু মেরামত করতে যেসব সরঞ্জাম প্রয়োজন, সেগুলো সবই চীন থেকে আনতে হয়। করোনা মহামারির পাশাপাশি যন্ত্রাংশ অতিরিক্ত দাম হওয়ায়, সঠিক সময়ে কেনাও সম্ভব হয়নি। বেশির ভাগ ডেমুই পড়ে আছে। আমরা পরিকল্পনা নিচ্ছি, দেশীয় সরঞ্জামের মাধ্যমে এগুলোকে সচল করার। চীন থেকে সরঞ্জাম কিনে এসব মেরামত করতে গেলে অনেক অর্থের প্রয়োজন। বেশ কয়েকটি রুটে ডেমু চলাচল করছে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে-পড়ে থাকা ডেমুগুলো ঠিক করার। আমরা ডেমু মেরামতে ওয়ার্কশপও নির্মাণ করছি।
এদিকে রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী বলেন, আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ডেমু সচল রাখার চেষ্টা করছি। নিজস্ব জনবল আর অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান দ্বারা মেরামতও করা হচ্ছে। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে পুরো ডেমু ট্রেনই একটি নির্দিষ্ট সফওয়্যার দ্বারা পরিচালিত হয়। কোচ ও ইঞ্জিনের ভেতর দিকে সব যন্ত্রাংশ, যা সফওয়্যার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সবগুলো ডেমু যথাযথভাবে সচল করতে হলে ক্রয়ের প্রায় সমতুল্য অর্থের প্রয়োজন। তাছাড়া শুধু চীন থেকে মেরামতের জন্য যন্ত্রাংশ ক্রয় করতে হবে। এসব যন্ত্রাংশ বিশ্ববাজার মূল্যের প্রায় ৮ থেকে ১০ গুণ বেশি। ডেমু মেরামতে আমরা তেমন অর্থও পায়নি, বরাদ্দ নেই বললেই চলে। আমরা চেষ্টা করছি দেশীয় প্রযুক্তিতে ডেমুগুলো সচল করতে-সচল রাখতে। দেশীয় যন্ত্রাংশ এবং আমাদের টেকনিশিয়ান দিয়েই মেরামত করা হবে-ইনশাআল্লাহ।
প্রসঙ্গত, যাত্রীসেবা আরও উন্নত করতে ২০১৩ সালে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৬৪৫ কোটি টাকায় ২০ সেট ডেমু কেনা হয়। চীন থেকে আনা এসব ডেমু শুরু থেকেই বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাচ্ছিল না। শীতপ্রধান দেশের উপযোগী ডেমুগুলো চালুর পর যাত্রীরা স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। খোলা জানালা না থাকায় প্রচণ্ড গরমে যাত্রীদের কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে কোচের নির্ধারিত স্থান কেটে বিকল্প জানালা তৈরিসহ স্বয়ংক্রিয় দরজা ম্যানুয়াল করা হয়। কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে অচল হতে থাকে ‘আধুনিক’ ডেমুগুলো।
রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ডেমুগুলো ক্রয়ে সুদূর কোনো পরিকল্পনা ছিল না। চীনের তৈরি এসব ডেমু চীনে ভালোই চলছে। নিজস্ব সফটওয়্যারে মাধ্যমে ডেমুগুলো বাংলাদেশে চালানোর দায়িত্ব ছিল চীন থেকে আগত প্রকৌশলীদের। কিন্তু চালুর শুরু থেকেই ইঞ্জিনসহ কোচ প্রচণ্ড গরম হয়ে ওঠে। নানা কৌশলে চুক্তি অনুযায়ী নির্ধারিত সময় পর্যন্ত চীনের প্রকৌশলীরা ট্রেনগুলো পরিচালনা করে চলে যান।
আরও জানা গেছে, ট্রেনগুলো কেনার আগে রেলওয়ের পক্ষ থেকে রক্ষণাবেক্ষণ ও নির্ধারিত ওয়ার্কশপ-শেড তৈরি করা হয়নি। এগুলোর ইঞ্জিন ও যন্ত্রাংশ বেশ নিচে। উপযুক্ত ওয়ার্কশপ ও যন্ত্রাংশ না থাকায় যথাযথ মেরামতও করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া চীন থেকে আসা প্রকৌশলীরা রেলের সংশ্লিষ্ট কাউকে প্রশিক্ষণও দেয়নি।
রেলওয়ে অপারেশন, ট্রাফিক ও যান্ত্রিক প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, শুরুর প্রথম পাঁচ বছরে এসব ট্রেন থেকে রেল আয় করে প্রায় ১৯ কোটি টাকা। একই সময়ে ব্যয় হয় প্রায় ২৭ কোটি টাকা। ২০১৮ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা। আয় হয়েছে খুবই সামান্য। এর পরের বছরগুলোতে আয় হয় ২ কোটি টাকার মতো। এতে তেল খরচই ওঠেনি। বর্তমানে ২০টি ডেমুর মধ্যে ১৬টিই অচল। এর মধ্যে ঢাকা লোকোশেডে ৯টি ডেমু ট্রেন বছরের পর বছর ধরে ফেলে রাখা হয়েছে। দিন দিন তা ধ্বংস হচ্ছে।
দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় রীতিমতো জঙ্গলে ঢেকে গেছে ট্রেনগুলো। নষ্ট হচ্ছে ইঞ্জিনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। ঢাকা বিভাগে চলাচলকারী ১২টি ডেমু ট্রেনের মধ্যে সচল আছে তিনটি। পশ্চিমাঞ্চলে মাত্র ১টি ডেমু ট্রেন চলাচল করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ট্রেন চালক-গার্ড জানিয়েছেন, সার্বিক প্রস্তুতি না নিয়ে ডেমু কেনার সিদ্ধান্তই ভুল ছিল সংশ্লিষ্টদের। প্রায় ২ বছর ধরে চীনের প্রকৌশলীরাই ডেমুগুলো চালিয়েছিল। ওই সময়ে কোনো যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে-তারাই (চীনের প্রকৌশলী) মেরামত করতেন। কোনো অবস্থাতেই রেলওয়ের কাউকে মেরামতের কৌশল বুঝিয়ে দেয়নি।
বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগে অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক বলেন, আধুনিক এবং যাত্রী সুরক্ষায় অধিক আরামদায়ক ডেমু ট্রেন-এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েই কেনা হয়েছিল। কিন্তু দেশের মাটিতে যাত্রা শুরুর ২ বছর না যেতেই বিকল হতে থাকে ট্রেনগুলো। এটি ভয়ানক প্রতারণা। বাহারি প্রতিশ্রুতির সঙ্গে দুর্নীতি-অনিয়ম রয়েছে। পরিকল্পনা থেকে শুরু করে ক্রয় কার্যে এবং চীনে যে সব কর্মকর্তা পরিদর্শনে গিয়েছিল সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক। মাত্র ৭ বছরে প্রায় সব কয়টি ডেমু অকেজো হয়ে পড়েছে। নতুন ট্রেন, কোচ ক্রয়ের সঙ্গে রেলপথ তৈরি করলেই হবে না, সুদূর পরিকল্পনা না থাকলে এসবের কোনো সুফল সাধারণ মানুষ পাবে না। ক্রয় ও নির্মাণ কাজে যারা সম্পৃক্ত তারাই শুধু লাভবান হবে। ক্রয়ের আগে ওয়ার্কশপ নির্মাণ, দক্ষ টেকনিশিয়ান এবং যন্ত্রাংশ পাওয়ার নিশ্চয়তা কেন সম্পূর্ণ করা হয়নি এগুলো যেসব দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নিশ্চিত করার কথা, তাদেরও জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন