রাজধানীর পূর্ব জুরাইনের সমাজকর্মী মিজানুর রহমান। যিনি ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) শরবত খাওয়াতে চেয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন পরিবারের সদস্য এবং এলাকার কয়েকজন। হাতে ছিল বোতলে সংগ্রহ করা ওয়াসার দূষিত পানি। শরবত বানানোর অনুষঙ্গ গ্লাস, লেবু ও চিনি। গিয়েছিলেন ওয়াসা ভবনের সামনে। বিশুদ্ধ পানির দাবিতে ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর তার এই ব্যতিক্রমধর্মী আন্দোলন সর্বত্র হইচই ফেলে দিয়েছিল।
খবরটি দেশ ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও জায়গা করে নেয়। সে সময় ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান তাদের সাক্ষাৎ দেননি। তবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছিলেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওয়াসার পানি বিশুদ্ধ করতে সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া হবে। এরপর ওয়াসার পানি দিয়েই তারা নাগরিক অধিকারকর্মী মিজানের হাতেই শরবত খাবেন। কিন্তু সে শরবত আর খাওয়া হয়নি। পার হয়েছে দুই বছর। সংকট সেই তিমিরেই। কোনো উদ্যোগ নেয়নি ওয়াসা। মিজানুর রহমানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যুগান্তরের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মতিন আব্দুল্লাহ
যুগান্তর : পূর্ব জুরাইন এলাকায় ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত দূষিত পানির সমাধান হয়েছে?
মিজানুর রহমান : না। এখনো সমাধান হয়নি। আগের মতো দূষিত ও ময়লা পানি সরবরাহ অব্যাহত রয়েছে।
যুগান্তর : আপনাদের আন্দোলনের পর ঢাকা ওয়াসার কর্মকর্তারা পূর্ব জুরাইন পরিদর্শন করেছিলেন?
মিজানুর রহমান : পানি সমস্যার সমাধান করতে কেউ আসেননি। তবে আমাকে ভয়ভীতি দেখাতে ওয়াসার কয়েকজন প্রকৌশলী দুদফায় এসেছিলেন। যেদিন আমরা ঢাকা ওয়াসা ভবনে এমডিকে দূষিত পানির শরবত খাওয়াতে গিয়েছিলাম, সেদিন বিকালে এবং পরের দিন দুপুরে কয়েকজন প্রকৌশলী এসে আমাকে অপমানজনক কথা বলে গেছেন।
যুগান্তর : এরপর কী হাল ছেড়ে দিয়েছেন?
মিজানুর রহমান : না। হাল ছেড়ে দেওয়ার লোক আমি নই। সামাজিক প্ল্যাটফরমে সবসময় পূর্ব জুরাইন এলাকার পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, মশা, জলাবদ্ধতা ও সড়ক সমস্যার সমাধানের জন্য আন্দোলন করে যাচ্ছি।
যুগান্তর : কেন আপনি এ ধরনের সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত হলেন?
মিজানুর রহমান : প্রথমত, সেবাবঞ্চনা। দ্বিতীয়ত, জীবন সম্পর্কে নতুন এক উপলব্ধি আমার মধ্যে জাগ্রত হয়েছে। এতদিনে বুঝতে পেরেছি-একজন মানুষ হিসাবে শুধু খাওয়া-দাওয়া, বিনোদন এবং ছেলেমেয়ে লালন-পালন করাই কাজ নয়। এ কাজগুলো একটা স্বাভাবিক জীবনে সবাই করে থাকেন। এমন জীবন বহুদিন থেকে উপভোগ করে আসছি। এর বাইরেও মানুষ হিসাবে মানুষের জন্য অনেক দায়িত্ব আছে। তিনি বলেন, দেখুন এ জীবনটা বহু মানুষের কারণে সচল আছে। আমি ঢাকার সন্তান। শাক, সবজি, ফলমূল ও ধান-চাল উৎপাদন হয় গ্রামে। যা আমরা এ শহরে বসেই খাচ্ছি। এসব খেয়ে জীবন ধারণ করছি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যতটুকু অর্জন করেছি সেখানেও বহু মানুষের অবদান রয়েছে। সেই বিবেচনা বোধ থেকে মনে হয়েছে মানুষের প্রতি আমার অনেক দায় রয়েছে।
যুগান্তর : প্রতিবন্ধকতাকে কিভাবে মোকাবিলা করছেন?
মিজানুর রহমান : সমাজ যেহেতু স্বাভাবিক ও সুস্থ ধারায় চলে না। সমাজকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে হয়। সেজন্য ভালো কিছুর জন্য নানাভাবে লড়াই তো করে যেতে হবে। আজ আমি, আমরা করছি। কাল অন্যরা করবে। এটা চলতেই থাকবে। নাগরিক আন্দোলন কখনও শেষ হয় না। সব ধরনের ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে এক শ্রেণির মানুষ সব সময় এ আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকে।
যুগান্তর : পূর্ব জুরাইন ও জুরাইন এলাকার পানি দূষিত কেন?
মিজানুর রহমান : পূর্ব জুরাইন এলাকার পানি ব্যবহারের অভিজ্ঞতা আমার বিগত ৪০ বছরের। শুরুর দিকে আমরা ট্যাবের পানি সরাসরি পান করতাম। এরপর পানির মান খরাপ হওয়ায় পানি ফুটিয়ে পান করতাম। বর্তমানে বাধ্য হয়ে ওয়াসার পানি ব্যবহার করছি। তিনি বলেন, এ এলাকার ওয়াসার পানি সরবরাহ লাইন অনেক পুরাতন। কিন্তু সেগুলো পরিবর্তন করা হচ্ছে না। সহসা করা হবে বলেও মনে হচ্ছে না।
যুগান্তর : ঢাকা ওয়াসার এমডিকে দূষিত পানির শরবত খাওয়ানোর কর্মসূচির চিন্তা কিভাবে এল?
মিজানুর রহমান : ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান ২০১৯ সালের অক্টোবরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি বিশুদ্ধ। সবাই নির্ভয়ে খেতে পারবেন। এ কথা শোনার পর জুরাইনবাসীসহ তার মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কেননা, তখনও জুরাইবাসীকে ওয়াসার দূষিত পানি বাধ্য হয়ে খেতে হচ্ছিল। ওই অবস্থায় তারা কিছু লোক মিলে এমন ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিবাদের আয়োজন করেন।
যুগান্তর : কিভাবে এই সামাজিক আন্দোলনকে সংগঠিত করছেন?
মিজানুর রহমান : আমাদের কোনো সংগঠন নেই। তবে এলাকার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে। মাঝে মাঝে আমরা সভাও করে থাকি। পানি সংকটের সমাধান চেয়ে প্রথমে আমিই প্রতিবাদ করে মাঠে নেমেছিলাম। সে সময় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে দেওয়া ওয়াসার এমডির বক্তেব্যে প্রতিবাদ ফেসবুকেও করেছিলাম। তবে আমার সে প্রতিবাদে অনেকে যুক্ত হন। এরপর সিদ্ধান্ত হয় আমরা এলাকার দূষিত পানি ওয়াসা ভবনে নিয়ে যাব। এলাকার এক ছোট বোনের প্রস্তাব ছিল-শুধু পানি না নিয়ে শরবত বানানোর প্রক্রিয়া হলে ভালো হবে। তার প্রস্তাবটি সাদরে গ্রহণ করি। এরপর দূষিত পানির শরবত খাওয়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। পরে সাংবাদিকরাও এ ব্যাপারে উৎসাহ দেখান। সাংবাদিকরা জানতে চান, আমরা কতজন সেখানে যাব। উত্তরে বলেছিলাম, আমি যাব-এটা নিশ্চিত। এ কথা শুনে আমার বউ বলেন, যদি কেউ না যান, সে যাবে। শেষমেশ ওইদিন আমার সঙ্গে আমার বউ ও এক সন্তান গিয়েছিল। পাশাপাশি এলাকার আরও কিছু লোকজন শামিল হন। তবে শক্তি, সামর্থ্য থাকলে অন্যরকম প্রতিবাদ জানাতাম।
যুগান্তর : জুরাইনের মানুষ কী এখনো দূষিত পানি পান করছেন?
মিজানুর রহমান : জেনে, না জেনে সবাই এখানে দূষিত পানি পান করছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫৩ নম্বর ওয়ার্ডে মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুলকেন্দ্রিক প্রায় ২০টি গভীর নলকূপ রয়েছে। কিন্তু এই পানির মানও খারাপ। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় এটি প্রমাণিত হয়েছে। ফলে জুরাইনবাসী কোনোভাবে বিশুদ্ধ পানির নাগাল পাচ্ছেন না।
যুগান্তর : সংকটের সমাধান কেন হচ্ছে না?
মিজানুর রহমান : আমাদের সমাজে ক্ষমতাবানদের প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে বেশি ক্ষমতাবানরা সেখানে বসবাস করেন সেখানে শুধু পানি নয়, সব সমস্যার সমাধান দ্রুত সমাধান হয়ে যায়। হয়তো আমাদের এখানে ওই রকম কেউ নেই।
যুগান্তর : কবে থেকে এ আন্দোলন করছেন?
মিজানুর রহমান : অনেক আগে থেকে। ২০১২ সালে জুরাইন এলাকার বহু মানুষের স্বাক্ষর নিয়ে ঢাকা ওয়াসার এমডি বরাবর আবেদন করা হয়। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আবেদন জমা দিয়েছিলাম। সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিলেও তিনি কিছুই করেননি। অথচ শুধু ২-৪টি বাড়িতে নয়, সুপেয় পানির সংকটে পূর্ব জুরাইন এবং আশপাশের এলাকার প্রায় ১০ লাখ মানুষ অতিষ্ঠ।
যুগান্তর : ডেঙ্গি সংকট নিয়ে এবার আন্দোলন করতে গিয়ে কোনো বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে?
মিজানুর রহমান : হ্যাঁ, এবারও প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু এটি করতে গিয়ে আমার পরিবারের সদস্যদের রীতিমতো অসুস্থ বানিয়ে ফেলে সিটি করপোরেশন। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে দুই দফায় আমার বাড়িতে অতি মাত্রায় ফগিং করে পরিবেশ বিষাক্ত বানিয়ে ফেলা হয়। এতে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি। ২০১৯ সালে ডেঙ্গির প্রতিবাদ করায় সিটি করপোরেশনের ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে অন্যায়ভাবে আটক করেছিলেন। তবে সাংবাদিকের প্রশ্নের মুখে পড়ে সেদিন ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন