করোনাকালে দেশে ই-কমার্স খাতের খুব দ্রুত প্রসার ঘটে। বর্তমানে এ বাজারের আকার প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের মধ্যে এ খাত ২৫ হাজার কোটি টাকার মাইলফলকে পৌঁছবে। কয়েক বছরে এ খাতে কর্মসংস্থান
হয়েছে দেড় লাখ মানুষের। ঠিক এই সময়ে এসে কিছু অসৎ উদ্যোক্তার কারণে ই-কমার্সের দারুণ এ যাত্রা বড় ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। তাদের জালিয়াতির কারণে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যবসা তথা ই-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনার খাতটি আস্থার সংকটে পড়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জালিয়াত প্রতিষ্ঠানগুলোয় গ্রাহক-সরবরাহকারীদের যে পরিমাণ টাকা আটকে রয়েছে, তা দেশের অর্থনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকি তৈরি করছে।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপের কাছে কয়েক লাখ ক্রেতা ও পণ্য সরবরাহকারী প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা পাবে। এসব প্রতিষ্ঠান ক্রেতাদের থেকে আগাম টাকা নিলেও সময়মতো পণ্য সরবরাহ করেনি। আবার যাদের থেকে বাকিতে পণ্য নিয়েছে তাদের মূল্যও পরিশোধ করেনি। একপর্যায়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ইভ্যালিতে তদন্ত চালায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, ক্রেতা ও সরবরাহকারীদের কাছে ৪১৩ কোটি টাকা দায় রয়েছে ইভ্যালির। কিন্তু তাদের চলতি সম্পদের মূল্য মাত্র ৬৫ কোটি টাকা। যদিও ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল নিজে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে যে হিসাব দিয়েছেন তাতে বলেছেন, তার কোম্পানির দেনার পরিমাণ ৫৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ক্রেতারা পাবেন ৩১১ কোটি, সরবরাহকারীরা ২০৬ কোটি এবং অন্যান্য ব্যবসায়ীর পাওনা ২৬ কোটি টাকা। ই-অরেঞ্জের গ্রাহকরা পাওনার দাবিতে রাজধানীতে বিক্ষোভ করলে এর মালিকানায় সম্পৃক্ত পুলিশ কর্মকর্তা সোহেল রানা দেশ ছেড়ে পালান। এই কোম্পানির কাছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা পাওনা গ্রাহকদের। ধামাকা শপের কাছে গ্রাহকদের ৮৫০ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে। প্রতিষ্ঠান তিনটি এখন বন্ধ। এসব টাকা দেশের অর্থনীতিতে নতুন করে ঝুঁকি তৈরি করেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এটি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিতে পড়বে দেশের অর্থনীতি।
দেশের ই-কমার্সের বাজার বিস্তৃত হতে শুরু করে বছর পাঁচেক আগে। তিন বছর ধরে এই খাতের প্রবৃদ্ধি প্রায় শতভাগ। অর্থাৎ, প্রতিবছর প্রায় দ্বিগুণ হচ্ছে খাতটি। করোনা পরিস্থিতিতে গত বছরের মার্চে সাধারণ ছুটি শুরু হলে ই-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বর্তমানে ই-কমার্স বাজারের আকার প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকার। ২০২৩ সালের মধ্যে এটি ২৫ হাজার কোটির মাইলফলকে পৌঁছবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন জানান, কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রতারণামূলক আচরণের এ জন্য এ খাত বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এর নেতিবাচক প্রভাব দেশের অর্থনীতির অন্য ক্ষেত্রেও পড়বে। এই অবস্থায় বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধান সংশোধন এবং প্রতারক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সেগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করা উচিত।
সিপিডির এক গবেষণায় দেখা গেছে, অনলাইন কর্মসংস্থানে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহৎ। বিশ্বে অনলাইনভিত্তিক শ্রমবাজারের ১৬ শতাংশই বাংলাদেশের। করোনাকালে যারা চাকরি হারিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে ই-কমার্সে আসছেন। কিন্তু এ খাতে মানুষের আস্থা দৃঢ় হওয়ার আগেই তাতে চিড় ধরতে শুরু করেছে। এই সংকট কাটাতে না পারালে সামনে তা বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করে উন্নয়ন সহযোগীরাও। অবশ্য তারা এ ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। তবে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা ও মন্ত্রীদের সঙ্গে একক আলোচনায় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাইকা, ডিএফআইডি, ইউএসএইডসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ও দেশ অনলাইন ব্যবসায় প্রতারণা ও জালিয়াতির বিষয়ে সতর্ক করেছে বাংলাদেশকে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক বা ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং। বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং অল্প সময়েই প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে। আবার ই-কমার্সেও একটি বড় দিক হচ্ছে অনলাইন লেনদেন। অনলাইন ব্যবসা বিস্তৃতির এই সময়ে এ খাতে প্রতারণা ও জালিয়াতির ঘটনা ঘটায় বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে উন্নয়ন সহযোগীরা। এ খাতে সরকারের নিয়ন্ত্রণ, তদারকির যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। একই সঙ্গে উপযুক্ত আইন ও বিধিবিধানেরও অনুপস্থিতি রয়েছে বলে তারা মনে করেন। এ জন্য এ খাতে সুশাসনের অভাব দেখা দিয়েছে। আর এই সুশাসনের অভাবই ই-কমার্স খাতকে বিতর্কের মুখে ফেলেছে। এ জন্য উপযুক্ত আইন ও বিধিবিধান করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, বর্তমানে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সদস্য দেড় হাজারের বেশি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের তালিকাতেও আছে এক হাজার প্রতিষ্ঠানের নাম। গবেষণা সংস্থা লাইটক্যাসল পার্টনার্সের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ই-কমার্সের বাজার দাঁড়াবে সাড়ে ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো। পাঁচ বছর আগেও ২০১৬ সালে বাজারটি ছিল ৫৬০ কোটি টাকার। এ খাতে ফেসবুকভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫০ হাজারের বেশি। গত কয়েক বছরে সব মিলিয়ে ই-কমার্স খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে দেড় লাখ মানুষের।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন