পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইমের অধীনে তদন্তাধীন আটটি অর্থপাচার মামলার তথ্য হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে। প্রতিবেদনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ মোট ছয় দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া ১০ কোটি ১০ লাখ ডলারের তথ্যও রয়েছে এ প্রতিবেদনে। তবে এ ঘটনায় অপরিচিত হ্যাকাররা অভিযুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- রিজার্ভ চুরির ৮ কোটি ১০ লাখ ইউএস ডলার যায় ফিলিপাইনে এবং দুই কোটি ইউএস ডলার শ্রীলংকায় পাচার করা হয়। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে তিন কোটি ৪ লাখ ৫০ হাজার ডলারের মতো। তালিকায় উল্লিখিত বাকি সাতটি মামলায় পাচারকৃত মোট অর্থের পরিমাণ ৩১০ কোটি ৮০ লাখ ১৪ হাজার ৭৪৬ টাকা। এসব অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে নাম উল্লেখ করা হয়েছে- যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ও ক্যাসিনোকা-ের মূলহোতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, বহিষ্কৃত কমিশনার মোমিনুল হক সাঈদ, রাজীব হোসেন রানা, জামাল ভাটারা, শরিফুল ইসলাম, আওলাদ হোসেন, শাজাহান বাবলু, নাজমুল আবেদীন, সোহেলা আবেদীন, একেএম জাহিদ হোসেন, এঅ্যান্ডবি আটারওয়্যার অ্যান্ড নর্ম আউটফিট অ্যান্ড একসেসরিস লিমিটেড, সিইপিজেড-চিটাগাংয়ের। তবে সাতটি মামলার মধ্যে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও এনামুল হক আরমানের বিরুদ্ধে করা মামলায় সবচেয়ে বেশি ২৩২ কোটি ৩৭ লাখ ৫৩ হাজার ৬৯১ টাকা সিঙ্গাপুরে পাচারের তথ্য রয়েছে। সব মামলা তদন্তাধীন এবং পাচারকৃত টাকা উদ্ধারের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেওয়া আদেশ অনুযায়ী সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো. হুমায়ুন কবিরের স্বাক্ষরে প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়েছে। বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে আগামী সপ্তাহে এটি দাখিল করা হতে পারে বলে গতকাল রবিবার নিশ্চিত করেছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের রাষ্ট্রপক্ষের এই আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘এর আগে বিদেশে কারা অর্থ পাচার করেছে, তাদের বিষয়ে হাইকোর্ট জানতে চেয়েছিলেন। এ বিষয়ে সিআইডির পক্ষ থেকে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেটি আমাদের হাতে এসেছে। এফিডেভিটও করেছি। শুনানির দিন (২১ অক্টোবরের পর) এ প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে।’
রিটকারীদের একজন আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস অবশ্য আমাদের সময়কে বলেন, ‘প্রতিবেদনটি খুবই সংক্ষিপ্ত। এতে অর্থপাচারের সার্বিক চিত্র উঠে আসেনি। তা ছাড়া প্রতিবেদনে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তা পুরনো। এসব তথ্য সবারই জানা। তবে রিট মামলার প্রধান বিবাদীপক্ষ দুদক এখনো কোনো অগ্রগতি জানায়নি। সিআইডির ভূমিকা তো অনেক পরে। দুদকের উচিত ছিল আগে প্রতিবেদন দাখিল করা। কিন্তু সেটি করেনি তারা। এখন আদালত চালু হলেই রিট মামলাটি শুনানির জন্য উত্থাপন করা হবে।’
বাংলাদেশি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে সুইস ব্যাংকসহ গোপনে বিদেশে পাচার করা অর্থ অবিলম্বে ফেরত আনতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে গত ১ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়। ব্যারিস্টার আব্দুল কাইয়ুম খান ও অ্যাডভোকেট সুবীর নন্দী দাস এ রিট দায়ের করেন। এতে অর্থসচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, অ্যাটর্নি জেনারেল, বাণিজ্যসচিব, পররাষ্ট্রসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, আইনসচিব, দুর্নীতি দমন কমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ ১৫ জনকে বিবাদী করা হয়।
রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি করে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান থেকে সুইস ব্যাংকসহ বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে বিবাদীদের চরম ব্যর্থতা ও নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। পানামা পেপারস ও প্যারাডাইস পেপারসে যাদের নাম আসছে, তাদের বিষয়ে তদন্ত শুরু করার জন্য বিবাদীদের প্রতি কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না এবং এ বিষয়ে প্রতি মাসে কেন অগ্রগতি জানাতে নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় রুলে।
একই সঙ্গে সুইস ব্যাংকসহ বিদেশে বাংলাদেশি নাগরিকদের অতীতের এবং বর্তমানে এ ধরনের অর্থপাচার ও সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণে একটি স্পেশাল কমিটি গঠনের নির্দেশনা কেন দেওয়া হবে না- রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়। পাশাপাশি সুইস ব্যাংকসহ বিদেশে অর্থপাচারকারীদের নাম-ঠিকানা ও তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জানতে চান আদালত। সে অনুযায়ী সিআইডির পক্ষ থেকে প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়। আর এই প্রতিবেদনে দেওয়া তথ্যে তেমন তুষ্ট না হলেও নিয়ম রক্ষার জন্য সিআইডিকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন রিটকারী আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন