আমি মুসলমানের সন্তান, পূজা করি না; রাত জেগে তাহাজ্জুদ, ফজর ও রহমতের নামাজ আদায় করি। আল্লাহ, রসুল এবং ঢাকার ওস্তাদ এমরান চিশতীর নামে বাতি জ্বালিয়ে জিকির আসগার করি। গ্রামের মণ্ডলরা (মাতবর) আমাকে নিয়ে মিথ্যাচার করেন। নাস্তিক বানানোর ষড়যন্ত্র চলছে। তারা গ্রামের মসজিদের ইমামের পরামর্শে আমাকে জোর করে ঘর থেকে বের করে মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছেন। শরীরে জ্বর থাকা অবস্থায় গোসল করানোর পর কলেমা শাহাদত পাঠ করান। মণ্ডলরা অপরাধ থেকে বাঁচতে আমার বাবাকে হুমকি দিয়ে মিথ্যাচার করাচ্ছেন। তাদের ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে ওস্তাদ মতিন বাউলের আশ্রয়ে আছি।’
বৃহস্পতিবার দুপুরে অজ্ঞাত স্থান থেকে ফোনে এসব কথা বলছিলেন, নির্যাতনের শিকার বাউল মেহেদী হাসান। তিনি প্রশাসনের কাছে তার নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়েছেন।
শিবগঞ্জ থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম জানান, কিশোর বাউল নিরাপদে তার ওস্তাদের কাছে আছে। এখনো এলাকায় পুলিশ মোতায়েন আছে। অপর দুই মাতবরকে গ্রেফতারে এলাকায় অভিযান চলছে।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার সদর ইউনিয়নের জুড়ি মাঝপাড়া গ্রামের বেল্লাল হোসেনের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। একমাত্র ছেলে বাউল শিল্পী মেহেদী হাসান।
মেহেদী হাসান জানান, সংসারে অভাবের কারণে দাদা আলম মণ্ডলের বাড়িতে থাকেন। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছেন। ছোটবেলা থেকে বাউল গানের আসক্ত ছিলেন। তাই বাউল গান শেখার জন্য ওস্তাদ মতিয়ার রহমান মতিন বাউল ও হারমনি মাস্টার খলিলুর রহমানের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করেন। তাদের অনুসরণ করে বড় চুল রাখেন এবং সাদা রঙের গামছা, ফতুয়া ও লুঙ্গি পরিধান করেন। দুই ওস্তাদের সঙ্গে থেকে মুক্তা সরকার, কাজল দেওয়ান, লতিফ সরকার, আমজাদ সরকার ও শাহ আবদুল করিমের অন্তত ১০০ বাউল মুর্শিদী গান মুখস্থ করেন। ওস্তাদদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে গান থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।
তিনি জানান, তার সাদা পোশাকে চলাফেরা ও বিভিন্ন এলাকার অনুষ্ঠানে বাউল মুর্শিদী গান পরিবেশন করায় গ্রামের মণ্ডল (মাতবর) শাফিউল ইসলাম খোকন, শিক্ষক মেজবাউল ইসলাম, তারেক রহমান, ফজলু মিয়া, আবু তাহের, মসজিদের ইমাম মোখলেসুর রহমান প্রমুখ ষড়যন্ত্র শুরু করেন। মণ্ডলরা তাকে এবং ওস্তাদদের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করতেন। প্রতিবাদ করলে মণ্ডলরা তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন।
মেহেদী হাসান জানান, গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে তিনি ঘরে জিকির আসগার করছিলেন। এ সময় অতর্কিতভাবে ঘরে ঢুকে মণ্ডলরা তাকে টেনে বের করেন। এরপর জুড়ি মাঝপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মোখলেসুর রহমানের কাছে ফোনে নেওয়া পরামর্শে মেশিন দিয়ে তার মাথা ন্যাড়া করে দেন। এরপর শরীরে জ্বর থাকা অবস্থায় তাকে গোসল করিয়ে কলেমা শাহাদত পাঠ করতে বাধ্য করেন।
তিনি বলেন, ফজলু মিয়া নামে এক আসামি বিছানার বালিশের নিচ থেকে দেড় হাজার টাকা চুরি করে নিয়ে যান। যাওয়ার আগে মণ্ডলরা বাউল গান বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। অন্যথায় তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে ওস্তাদ মতিন বাউলের আশ্রয়ে চলে যান।
এ ব্যাপারে শিবগঞ্জ থানায় পাঁচ মাতবরের বিরুদ্ধে মামলা করেন মেহেদী হাসান। ২১ সেপ্টেম্বর রাতে পুলিশ মাতবর শাফিউল ইসলাম খোকন, শিক্ষক মেজবাউল ইসলাম ও তারেক রহমানকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। পরদিন তাদের আদালতের মাধ্যমে বগুড়া জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে ঘটনার পর থেকে বাউল মেহেদী হাসানের বাবা বেল্লাল হোসেন প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং সাংবাদিকদের বলছেন, তার ছেলে বাউল গানের নামে ঘরে মূর্তি পূজা করতেন। তাই তিনি নিজে তার ছেলের মাথা ন্যাড়া ও তাকে কালেমা পড়িয়েছেন। এতে গ্রামের মণ্ডলদের কোনো দোষ নেই। তার ছেলে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছে।
এ প্রসঙ্গে নির্যাতনের শিকার বাউল মেহেদী হাসান জানান, তিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় না করলেও ঘরে রাত ১০টা থেকে ফজরের ওয়াক্ত পর্যন্ত আল্লাহ, রসুল এবং তার ওস্তাদের নামে বাতি জ্বালিয়ে জিকির আসগার করেন। এছাড়া তাহাজ্জুদ, ফজর ও রহমতের নামাজ আদায় করেন। রসুলের গুণগান করেন। ঘরে কোনো পূজা করেন না।
তিনি দাবি করেন, মণ্ডলরা মামলা থেকে বাঁচতে তার বাবাকে হুমকি দিয়ে এসব বলতে বাধ্য করছেন।
বাউল মেহেদী বলেন, ফোনে জানতে পারেন বর্তমানে তার পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তহীনতায় রয়েছেন। তিনি মণ্ডলদের ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন; ফিরতে পারছেন না। দুই ওস্তাদের সঙ্গে অজ্ঞাত স্থানে রয়েছেন। মেহেদী প্রশাসনের কাছে তার পরিবার, দুই ওস্তাদ ও নিজের নিরাপত্তা চেয়েছেন।
তবে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক জুড়ি মাঝপাড়া গ্রামের কয়েকজন জানান, মেহেদী হাসান ঘরে আসন বানিয়ে তার সামনে বসে পূজা করে থাকে। নিজের বাবা তার চুল কেটে, কালেমা পড়িয়ে শুদ্ধ করেছেন। এখানে গ্রামের মণ্ডলদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। মেহেদী অন্যের প্ররোচনায় গ্রামের কয়েকজন মুরব্বির বিরুদ্ধে থানায় মিথ্যা মামলা দিয়েছে। পুলিশ ইতোমধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে। ধর্মীয় উস্কানি না ছড়াতে এলাকায় পুলিশের পক্ষে মাইকিং করা হয়।
শিবগঞ্জ থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম জানান, নির্যাতনের শিকার বাউল মেহেদী হাসানের এজাহার অনুসারে তিন মাতবরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে এখনো তদন্ত চলছে। অন্য দুইজনকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। তারা কোর্টে আত্মসমর্পণ করতে পারেন। বর্তমানে এলাকায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে; পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে। এছাড়া বাউল তার ওস্তাদদের সঙ্গে নিরাপদে আছে। সে দিনাজপুরে অনুষ্ঠানে যাবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন