পিরোজপুরের জিয়ানগরের কিশোরী রিয়া (প্রকৃত নাম নয়) অভাবের তাড়নায় ঢাকায় আসে বছর তিনেক আগে। একটি পোশাক কারখানায় কাজ নেয়। থাকত যাত্রাবাড়ীর উত্তর কাজলায়। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে পরিচয় হয় জেসমিন আক্তার নামের এক নারীর সঙ্গে। জেসমিন তাকে উন্নত জীবনযাপনের টোপ দেন। ভারতের মুম্বাইয়ে পার্লারে কাজ দেওয়ার কথা বললে সহজেই রাজি হয়ে যায় রিয়া। ওই বছরের ২৭ অক্টোবর জেসমিনের হাত ধরে রিয়া পা বাড়ায় ‘উন্নত জীবনের’ খোঁজে; অবশ্য তা থেমে যায় সীমান্তেই। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া নারীদের ভারতে নিয়ে বাধ্য করা হয় দেহব্যবসায়। এদিক দিয়ে রিয়ার ভাগ্য ভালো! অবৈধ উপায়ে ভারতে প্রবেশকালে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে ধরা পড়ে দুজন। জেসমিনের বিরুদ্ধে অনুপ্রবেশের মামলা করে ভারতীয় পুলিশ। রিয়ার ঠাঁই হয় কলকাতার একটি আশ্রয়কেন্দ্রে। প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া শেষ করে গত সোমবার রিয়াকে দেশে ফেরত আনা হয়। প্রত্যাবাসনের এই যাত্রায় রিয়ার সঙ্গী ছিল আরো ৩৬ জন, যারা বিভিন্ন সময় পাচারের শিকার।
অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন কর্মকর্তা জানান, মানব পাচারকারী চক্র গ্রামে-গঞ্জে এমনভাবে ওত পেতে রয়েছে, তাদের ঠেকাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হচ্ছে। অভিযান চললেও মানবপাচার ঠেকানো যাচ্ছে না। চক্রের হাজার হাজার সদস্য ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের মন-গলানো কথায় কাবু হয়ে যায় সরলমনা তরুণ-তরুণীরা। উন্নত জীবনের টোপ দিয়ে তাদের মূলত অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে দেওয়া হয়। বিশেষ করে পাচারের পর মেয়েদের বিক্রি করা হয়। আর ছেলেদের বন্দি রেখে পরিবারে দেওয়া হয় মুক্তিপণের বার্তা।
পিরোজপুরের তরুণী রিয়া এমনই এক পাচারচক্রের ‘টার্গেট’ ছিল। তার বাবা ইব্রাহীম মৃধার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, রিয়া ঢাকায় আসার কয়েক মাস পর জেসমিন নামের এক মেয়েকে দেখতে পান তিনি। জেসমিনের বয়স আনুমানিক ২৬ বছর। তিনি রিয়ার সঙ্গে খুব মিশতেন। মাঝেমধ্যে বাসায়ও আসতেন। সেই জেসমিনই রিয়াকে পাচার করে দিচ্ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার ইব্রাহীম বলেন, ‘আমার মেয়ে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে জেসমিন তাকে বিক্রি করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ভারতে নিয়ে যাচ্ছিল। সে বলেছিল রিয়াকে পার্লারে চাকরি দেবে। এ ছাড়া জেসমিন এমনভাবে রিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, মনে হতো রিয়া তার ছোট বোন।’ এ ঘটনায় তিনি যাত্রাবাড়ী থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেছিলেন।
সিআইডি সূত্র জানায়, ২০০৪ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে পাচারের শিকার হয়েছে ১২ হাজার ৩২৪ জন। এসব ঘটনায় দেশে মামলা হয়েছে ছয় হাজার ৭৩৫টি। পাচারের শিকার ৯ হাজার ৭১০ জনকে উদ্ধার করেছে পুলিশ, র্যাব উদ্ধার করেছে এক হাজার ছয়জনকে। সারা দেশে পরিচালিত ৩৩৩টি অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় ৮৯৬ জনকে। তবে মানবপাচারের প্রকৃত চিত্র আরো ভয়াবহ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মানব পাচারকারী চক্রের বিস্তৃতির পেছনে বিচারহীনতাই দায়ী। দিনের পর দিন মামলার অগ্রগতি হয় না। দোষীদের আইনের আওতায় আনার হার একেবারেই কম। এমনকি মানবপাচারের ছয়-সাতটি মামলা থাকা সত্ত্বেও আসামির জামিন হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে খালাসও পেয়ে যায়। পরে তারা নতুন উদ্যমে একই অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি (অর্গানাইজড ক্রাইম) মাসুদ উল হাসান বলেন, অনেক সময় মামলা হলেও পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অগ্রগতি হয় না। ভুক্তভোগী যে তথ্য দেয়, তা সুবিচার লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। এসব কারণে মামলায় অগ্রগতি কম। এ অবস্থায় পাচার ঠেকাতে তৃণমূল পর্যায়ে গণসচেতনতা জরুরি। পাচারকারীচক্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিষয়ে পুলিশের কাছে তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি সামাজিকভাবেও প্রতিবন্ধকতা গড়ে তুলতে হবে। তিনি আরো বলেন, পুলিশ এ বিষয়ে তৎপর রয়েছে। বিশেষ করে কভিড-১৯ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর পাচারের ঢল বাড়তে পারে—এ ধারণা থেকে আগাম পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।
সূত্র মতে, পাচার চক্রের সদস্যরা ছদ্মবেশে সারা দেশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা প্রথমে একজনকে লক্ষ্য হিসেবে স্থির করে। এরপর ওই ব্যক্তির সঙ্গে মেলামেশা শুরু করে। বন্ধুত্ব গড়ে আরো কাছে আসার চেষ্টা করে। এমনকি ঘরে পর্যন্ত পৌঁছে যায়। চূড়ান্তভাবে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি, এমনকি তার অভিভাবকদের পর্যন্ত নানা রকমের টোপ দেওয়া শুরু করে। এ ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ে পারিবারিক অবস্থানেও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন বেসরকারি সংস্থা জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের কান্ট্রি ডিরেক্টর তরিকুল ইসলাম। তিনি আরো বলেন, কিছু মানুষের কাছে মানবপাচার হচ্ছে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। ফলে বারবার মামলার আসামি হলেও জামিনে বেরিয়ে কিংবা খালাস পেয়ে ফের একই অপকর্মে লিপ্ত হয়। মানব পাচার চক্র ভাঙার পর্যাপ্ত চেষ্টাই হচ্ছে না বলেও মনে করছেন তিনি।
আকাশপথে মানবপাচার বাড়তে পারে : আকাশপথে দীর্ঘদিন অচলাবস্থা থাকার কারণে সাগরপথে নেমেছিল মানবপাচারের ঢল। বিশেষ করে কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে মালয়েশিয়ায় পাচারের প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছিল। শুধু রোহিঙ্গারাই নয়, বাংলাদেশি নাগরিকদেরও দীর্ঘদিন ধরে এই রুটে পাচার করা হয়ে থাকে। অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়া ভ্রমণে ভিসার প্রয়োজনীয়তা না থাকার সুযোগ নিয়ে একটি চক্র মালয়েশিয়ায় পাচারে এই রুট ব্যবহার করে। অনেক দিন পর এখন আকাশপথে যোগাযোগব্যবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার ফলে এই রুটেও ফের সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে চক্রটি। জানা যায়, জাপান, ইন্দোনেশিয়ার পর গতকাল মালয়েশিয়াও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
সিআইডি সূত্র জানায়, ইউরোপে মানবপাচারে সক্রিয় ২০টিরও বেশি চক্র। কয়েকটি জেলার তালিকা ধরে চক্রের সদস্যরা মাঠে নেমে পড়ে। এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত আছে শত শত পাচারকারী। ওরা এমনভাবে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে, তাদের চিহ্নিত করতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে চক্রটি ভাঙা যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, ইউরোপে পাচারের ক্ষেত্রে কয়েকটি রুট ব্যবহার করে চক্রটি। এর অন্যতম হলো লিবিয়া। লিবিয়ায় পাচারকারীচক্রের নির্যাতনের বহু ঘটনা জানা সত্ত্বেও চক্রের খপ্পরে পড়ে রাজি হয়ে যায় অনেক তরুণ-যুবা। এই লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে এরই মধ্যে বহু বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। গত ২১ জুলাই এই রুটে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে ১৭ বাংলাদেশি মারা যান। এর আগে ২৪ জুন ভূমধ্যসাগর থেকে ২৬৪ বাংলাদেশিকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ২৮ ও ২৯ জুন নৌকায় অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরের তিউনিশিয়া উপকূলে নৌকাডুবিতে ৪৩ জন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটে।
ফিরলেন ৩৭ জন: বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, পাচারের শিকার ৩৭ জনকে তিন বছর পর দেশে ফেরত আনা হয়েছে। গত সোমবার বিকেলে বেনাপোল চেকপোস্টে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে তাদের হস্তান্তর করে ভারতীয় ইমিগ্রেশন পুলিশ। প্রত্যাবাসিত ব্যক্তিদের মধ্যে ২১ জন কিশোর, ১২ জন কিশোরী এবং চারজন নারী। ভালো কাজের প্রলোভনে পড়ে দালালের মাধ্যমে অবৈধ পথে তারা বিভিন্ন সময়ে ভারতে গিয়েছিল।
জানা গেছে, ফেরত আসা ৩৭ জনের মধ্যে মানবাধিকার সংস্থা জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার ১৯ জন, রাইটস যশোর ১৬ জন এবং জাতীয় মহিলা আইনজীবী সংস্থা দুজনকে গ্রহণ করে। এরা কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, মুন্সীগঞ্জ, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও, রাজবাড়ী, সুনামগঞ্জ, পিরোজপুর, নড়াইল, রাজশাহী, ফরিদপুর, বরিশাল, কুড়িগ্রাম ও পিরোজপুরের বাসিন্দা।
বেনাপোল চেকপোস্ট ইমিগ্রেশনের ওসি আহসান হাবিব জানান, সীমান্তপথে বিভিন্ন সময়ে ভারতে পাচার হওয়া ৩৭ জন কিশোর-কিশোরী ও নারী ভারত সরকারের দেওয়া বিশেষ ট্রাভেল পারমিটের মাধ্যমে দেশে ফিরেছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন