২০০৪ সালের ২০ আগস্ট রাতে রাজধানীর বাড্ডার একটি বাসা থেকে ইকবাল হোসেন ওরফে জাহাঙ্গীর ওরফে সেলিমের হাতে দুটি গ্রেনেড তুলে দেন মুফতি হান্নান। পরিকল্পনা অনুযায়ী পর দিন ২১ আগস্ট বেলা ২টার দিকে গুলিস্তানে পৌঁছে যায় ইকবাল। বিকাল ৪টার দিকে আওয়ামী লীগের সমাবেশ মঞ্চকে লক্ষ্য করে শুরু হয় গ্রেনেড হামলা। ইকবাল একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারে। একই সময় হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজিবি) অন্য জঙ্গিরাও গ্রেনেড ছুড়ে মারে সমাবেশস্থল লক্ষ্য করে। গ্রেনেডের তা-বে মুহূর্তেই আওয়ামী লীগের অফিসের সামনের অ্যাভিনিউসহ বিশাল স্থান ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তখনো হামলার উদ্দেশে নিয়ে আসা আরেকটি গ্রেনেড রয়ে গেছে ইকবালের কাছে। কিন্তু পরিস্থিতির ভয়াবহতা দেখে ভড়কে যায় সে। গ্রেনেডটি সঙ্গে নিয়েই পালিয়ে যায় এ জঙ্গি। সেদিন রাতে বাড্ডার যে বাসা থেকে গ্রেনেডটি নেওয়া হয়েছিল, সেই বাসায় ফিরে যায় ইকবাল; মুফতি হান্নানের কাছে জমা দেয় গ্রেনেডটি। নিজেকে বাঁচাতে আত্মগোপনে চলে যায় ইকবাল। সম্প্রতি র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হুজিবি সদস্য ইকবাল হোসেন।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি পলাতক ইকবাল হোসেনকে হামলার ১৬ বছর পর গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর উত্তরার
দিয়াবাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ায় থাকার পর গত বছরের শেষ দিকে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে আটক করে তাকে ঢাকায় ফেরত পাঠিয়ে দেয় মালয়েশিয়ার পুলিশ। দেশটিতে আত্মগোপন করে থাকাকালে ইকবাল হোসেন পৃথক দুটি পাসপোর্ট তৈরি করেন। রফিক ও আনসারী নামে ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট দুটো নেন। সেলিম ও জাহাঙ্গীরÑ এ দুটি ছদ্মনাম ছিল তার।
জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে ফিরে ইকবাল আত্মগোপনে ছিল। এ সময় সমমনাদের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন করে সে।
ফের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টায় হুজিবি
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এক বছরের মধ্যে হুজিবির প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় নেতা এবং গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এরই মধ্যে হুজিবির অন্যতম শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।
দীর্ঘদিন এই জঙ্গিগোষ্ঠীর কোনো তৎপরতা ছিল না। তবে সম্প্রতি হুজিবি ফের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে বলে তথ্য পেয়েছে জঙ্গিবাদ দমনে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলো। ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট, এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) ও র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় এবং সাংগঠনিক কোনো কাঠামো না থাকা হুজিবি ফের সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। নতুন সদস্য সংগ্রহ করে তৎপর হতে চাইছে।
২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর হুজিবির শীর্ষ নেতাসহ তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। তাদের মধ্যে মো. আতিকুল্লাহ ওরফে আসাদুল্লাহ ওরফে জুলফিকার (৪৯) বোমা বিশেষজ্ঞ। সে একসময় আল-কায়েদার তৎকালীন শীর্ষনেতা ওসামা বিন লাদেন, আয়মান আল জাওয়াহিরি ও তালেবান নেতা মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছিল। আতিকুল্লাহ ওই বছর দেশে ফিরে হুজিকে নতুন করে সংগঠিত করছিল বলে সিটিটিসি সূত্রের খবর। গ্রেপ্তার বাকি দুজন হলেনÑ মো. বোরহান উদ্দিন রাব্বানী (৪২) ও মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ওরফে শামীম (৪৩)।
সর্বশেষ ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাজশাহীর খড়খড়িবাজার এলাকা থেকে হুজিবির দুই সক্রিয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় গ্রেপ্তারকৃতরা হলেনÑ রাজশাহী ও খুলনা অঞ্চলের কমান্ডার ইব্রাহিম খলিল (৪১) ও সমন্বয়কারী আব্দুল আজিজ (২৩)। তখন পুলিশ জানিয়েছিল, কারাগারে থাকা হুজিবি নেতা আতিকুল্লাহর নির্দেশনায় সংগঠন পুনর্গঠনের কাজ করছিল গ্রেপ্তারকৃত দুই জঙ্গি।
আফগানফেরত মুজাহিদদের হাত ধরে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে হুজিবির জন্ম হয়। ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে এই জঙ্গিগোষ্ঠী দেশে ১৩টি বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এতে ১০৬ জন নিহত হন। আহত হন ৭০০-এর বেশি মানুষ। হুজিবির মতো ভারী অস্ত্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সম্মুখযুদ্ধের অভিজ্ঞতা অন্য জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের নেই। নব্য জেএমবির হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা বাদ দিলে দেশে সবচেয়ে বেশি ভয়ঙ্কর হামলা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটিয়েছে হুজিবি। তারা একাধিকবার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ও সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হামলা ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনর সমাবেশে গ্রেনেড হামলা। এতে ২৪ জন নিহত হন। আহত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কয়েকশ নেতাকর্মী। এ পর্যন্ত শুধু র্যাবের হাতে হুজিবির ১১৩ সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল মুহাম্মদ খায়রুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘গ্রেপ্তারকৃত ইকবাল জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য দিয়েছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।’
উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়েছে। আদালতে দীর্ঘ সাত বছরে সর্বমোট ২২৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ ও শুনানি শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এ মামলার যুগান্তকারী রায়ে অভিযুক্তদের মৃত্যুদ- যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন