দুপুরে অফিসে ছিলাম। খবর পেলাম, রাজধানীতেই বয়স বাড়িয়ে বাল্যবিবাহ এবং জোর করে বিয়ে দেওয়ার একটি ঘটনা ঘটেছে। ফেসবুকের একটি পোস্টের সূত্র ধরে বেলা একটার কিছু পর লালবাগ থানায় সেই মেয়ের বাসায় পৌঁছে দেখা গেল, বাসায় পুলিশ ঢুকছে। আধা ঘণ্টা পর তারা বেরিয়েও যায়। মেয়ের কয়েকজন বন্ধু এসেছে বাসার নিচে। মেয়েটির সঙ্গে বন্ধুরা যোগাযোগ করে জানাল, সে কেনাকাটা করতে স্বামীর সঙ্গে বের হয়েছে।
সাংবাদিক ও নারী অধিকারকর্মী বীথি সপ্তর্ষি এই বিয়ের ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। পোস্টটি গণমাধ্যমকর্মীদের নজরে আসে। ঘটনাস্থলে মেয়ের বন্ধুদের সঙ্গে বীথিও ছিলেন।
বেলা দুইটার দিকে মেয়ের নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ আসে, সে বিয়েতে রাজি ছিল না। আর আটকে রাখবে এবং ফোন নিয়ে যাবে, তাই সে কেনাকাটার জন্য বের হয়েছে। মেয়েটি রাজধানীর একটি স্বনামধন্য স্কুলের শিক্ষার্থী। সে এবার এইচএসএসি ২০২০ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিল। মেয়েটি জানায়, ১৫ জানুয়ারি পরিবার থেকে জোর করে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। এসএসসির সার্টিফিকেট অনুযায়ী তার বয়স এখনো ১৮ হয়নি। কিন্তু ছয় মাস আগে বাবা-মা অ্যাফিডেভিট করে জন্মসনদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে নেন। মেয়েটি জানিয়েছে, ‘আমি এই বিয়ে মানি না, বাসার সবাই মিলে আমাকে আমার রুমে আটকে রেখে জোর করে নাম লিখিয়ে, ধমক দিয়ে, আমার হাত থেকে টিপসই নিয়েছে।’ মেয়েটি জানায়, সে বিয়েটি ভেঙে দিতে চায়।
যাঁর সঙ্গে এই বিয়ের আয়োজন, তিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা। মেয়ের অভিযোগ, বিয়েতে তার অমত থাকার বিষয়ে সে ছেলেকে জানালেও তাতে কর্ণপাত করেননি।
এর মধ্যে বেলা আড়াইটায় মেয়ে এবং তার স্বামী বাসায় ফেরেন। বাসার নিচে থেকে বাবা ও স্বামীকে মেয়েটি জানিয়ে দেয়, সে বিয়েটা চায় না। বন্ধুদের সঙ্গে সে লালবাগ থানায় যায়। থানা আগে থেকেই বিষয়টি অবহিত। মেয়েটির ৯৯৯–এ করা ফোনের পর পুলিশ বাসায়ও গিয়েছিল।
থানা পর্ব
লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে এম আশরাফউদ্দিন মেয়ের মুখ থেকে সব কথা শোনেন। তিনি মেয়ের বাবাকে থানায় আসার জন্য বলেন। মেয়ের তিন চাচা, মা, বাবা ও স্বামী থানায় আসেন। এক চাচা থানায় ঢুকেই মেয়েটিকে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করেন।
মেয়েটির বন্ধু এবং সাংবাদিক বীথি সপ্তর্ষির সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে ওসি পুলিশের লালবাগ অঞ্চলের সহকারী পুলিশ কমিশনার কে এন রায় নিয়তিকে ডাকেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) পক্ষ থেকে মেয়েটিকে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্যও একজন আসেন।
কে এন নিয়তিও আবার দুপক্ষের বক্তব্য শোনেন। মেয়েটির স্বামী এই পুলিশ কর্মকর্তাকে জানান, মেয়ের পরিবার থেকে যে জীবনবৃত্তান্ত দেওয়া হয়েছে, সেখানে ১৮ বছরের বেশি। তিনি সার্টিফিকেটর বয়সের বিষয়টি জানতেন না। এদিকে মেয়ের পরিবারের দাবি, স্কুলে ভর্তির সময় তাঁরা বয়স কমিয়েছিলেন। পরে অ্যাফিডেভিট করে পুনরায় বয়স বাড়িয়ে নেন জন্মসনদে।
মেয়ের বাবা পুলিশকে বলেন, এখন মেয়ে যা চাচ্ছে, তা-ই হবে। মেয়ে তাঁদের ‘সম্মান’ নষ্ট করেছে। বিয়ের আগে মেয়ে অমতের কথা জানায়নি বলে বাবার দাবি। তবে মেয়ে বলছে, সে অনেকবার বলেছে এবং বিয়ের দিনও তাকে জানানো হয়নি, সেদিন তার বিয়ে। ছেলেপক্ষ আসার পর সে বুঝতে পারে বিয়ের বিষয়টি। এর আগেও তাকে কয়েকবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
অল্প বয়সেই মেয়েকে বিয়ে দেওয়া নিয়ে মেয়ের বাবা পুলিশকে বলেন, মেয়ে সুন্দর, তাই চারদিক থেকে বিয়ের চাপ আসে। অনেকে হুমকি দেয়। তাই নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তিনি মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।
বিয়ের পাঁচ দিন পর পুলিশকে জানানোর বিষয়ে মেয়েটি বলে, সে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, কিন্তু তাকে সরাসরি যেতে হবে। পরে সে আজ বৃহস্পতিবার ৯৯৯–এ ফোন করে। এ ছাড়া বন্ধুদের সাহায্য চায়।
শেষ পর্যন্ত তালাক
মেয়ে কী চায়—পুলিশ কর্মকর্তাদের এমন প্রশ্নে মেয়ে জানায়, সে কারও বিরুদ্ধে কোনো আইনি অভিযোগ করবে না। তালাক দিয়ে নিজে পড়াশোনা করে নিজের স্বপ্ন পূরণ করে চায়। এসএসসির সার্টিফিকেট অনুযায়ী যেহেতু মেয়ের বয়স ১৮ হয়নি, তাই আইন অনুযায়ী বাবা-মায়ের জিম্মায় থাকবে। পুলিশ এ প্রসঙ্গ তুললে মেয়ের বাবা ও চাচারা মেয়েকে নিতে রাজি হননি। তাঁরা বলেন, বাসায় নেওয়ার পর নানান জন নানান কথা বলবে এবং যেকোনো কিছু হতে পারে। তাই মেয়েকে তারা নেবেন না। মেয়ে যা খুশি করুক। পরিবারের এমন বক্তব্যে মেয়েটিও বলে, সে–ও পরিবারের কাছে যাবে না।
ছেলে ও মেয়ে—দুপক্ষই তালাকের জন্য রাজি হওয়ায় রাতেই কাজি ডেকে তালাকের ব্যবস্থা করা হয়।
ব্লাস্ট থেকে মেয়েটিকে আইনি সহায়তাকারী হাবিবা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, আজ মেয়েটি পুলিশি হেফাজতে থাকবে। ওসি জানিয়েছেন, মেয়েটিকে রাতেই তেজগাঁওয়ের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠানো হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন