স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি সিন্ডিকেট বছরের পর বছর একই কর্মস্থলে থেকে দুর্নীতি আর অনিয়ম করে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। টেন্ডারবাজি থেকে শুরু করে নিয়োগ এবং বদলি বাণিজ্যসহ সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করত সিন্ডিকেট। স্বাস্থ্যের কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, অফিস সহকারী প্রধান, পিয়ন আর ড্রাইভারসহ ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, জমিসহ দেশ-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এমনই সব দুর্নীতির তথ্য-প্রমাণ উঠে আসলে এই অসাধু সিন্ডিকেটের বলয় ভাঙতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে একটি চিঠি দেয় দুদক। ওই চিঠির আলোকেই ২৩ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পরের মাসেই বদলি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। আর শাস্তিস্বরূপ বদলিকৃত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর একজন হচ্ছেন স্বাস্থ্যের পরিচালক ঢাকা দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ফারুক হাসান।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাস্থ্য বিভাগের দুর্নীতিবাজ ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামের একটি তালিকা প্রস্তুতের পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। দুদকের ওই তালিকায় ফারুক হাসানের নাম ছিল ২ নম্বরে। ফারুক হাসান ওই সময় ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত ছিলেন।
দুদকের সুপারিশের আলোকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি ফারুক হাসানকে রাঙামাটি সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসাবে বদলি করে। কিন্তু তিনি রাঙ্গামাটিতে যোগদান করেননি। ৩ মাস পর ২০১৯ সালের ১২ মার্চ প্রভাব খাটিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে তার বদলির আদেশ পরিবর্তন করে বগুড়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ে বদলি হয়ে যান। কিন্তু সেখানেও বেশি দিন থাকেননি ফারুক হাসান। গত বছরের ১৬ মার্চ বগুড়া থেকে টাঙ্গাইল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে বদলি হয়ে আসেন। কিন্তু নির্বিঘ্নে দুর্নীতি চালিয়ে যাওয়ার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল ঢাকার কথা ভুলতে পারেন না ফারুক হাসান। টাঙ্গাইল জেলায় মন বসে না, ওপর মহলের তদবির চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আবারো ঢাকায় কাজের সুযোগ করে নেন তিনি। টাঙ্গাইল থেকে ৯ মাসের মধ্যে বদলি হয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আসেন গত বৃহস্পতিবার। দুদকের সুপারিশে যেখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ফারুক হাসানকে শাস্তিস্বরূপ রাঙ্গামাটিতে বদলি করে, যার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন অনুসন্ধান করছে ও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, যিনি অনিয়ম-দুর্নীতি-নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য করে বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন, সেই ফারুক হাসান ঢাকা থেকে বদলির দুই বছরের মাথায় তিন জেলা ঘুরে আবারো চলে এসেছেন সেই আগের কর্মস্থল ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে।
স্বাস্থ্যের এই বিতর্কিত কর্মকর্তা গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় বদলির চিঠি নিয়ে কাজে যোগ দিতে আসায় বেশ তোলপাড় শুরু হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। দুর্নীতির অভিযোগ যার মাথার ওপর রয়েছে, দুই বছরের মাথায় তিন জেলা ঘুরে আবার তার ঢাকায় বদলি হয়ে আসায় অনেকেই অবাক হয়েছেন, কেউ কেউ ক্ষু্ব্ধ।
দুদক থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন বিভিন্ন কার্যালয়ে কিছু দুর্নীতিবাজ, স্বেচ্ছাচারী ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে একই কর্মস্থলে চাকরি করার সুবাদে দুর্নীতির শক্তিশালী বলয় তৈরি হয়েছে। এদের কারণে অধিদপ্তরের সুশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর ‘দুর্নীতির বলয়’ তৈরি করা এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতার অপব্যবহার করে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। দুদকে তাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অনেক অভিযোগ জমা হয়েছে, যা দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের অনুসন্ধানের পর্যায়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজ ও স্বেচ্ছাচারী এই ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চিহ্নিত করেছে দুদক।
দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাই নন, তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীর এমন কিছু কর্মচারী রয়েছেন বেতনের টাকায় যাদের কোনোমতে জীবন ধারণের কথা। অথচ তারা একেকজন যেন টাকার কুমির! আছে আলিশান বাড়ি, বিলাসবহুল গাড়ি। নামে-বেনামে আছে হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি। দেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার করেছেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ পদের কর্মচারী আবজাল হোসেন ও তার স্ত্রীর সম্পদের অনুসন্ধান করতে গিয়ে ফাঁস হয় বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের তথ্য। মাত্র ১২শ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করা আবজাল এক দশকে হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন।
ফারুক হাসান ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ‘অঢেল সম্পদের মালিক’ হওয়া দুর্নীতিবাজ বদলিকৃত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হলেন- ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের সহকারী প্রধান (পরিসংখ্যানবিদ) মীর রায়হান আলী, প্রধান সহকারী আশরাফুল ইসলাম, প্রধান সহকারী সাজেদুল করিম, উচ্চমান সহকারী তৈয়বুর রহমান, সাইফুল ইসলাম। চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী ফয়জুর রহমান, প্রধান সহকারী মাহফুজুল হক, কম্পিউটার অপারেটর আজমল খান, ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান, প্রধান সহকারী-কাম-হিসাবরক্ষক আব্দুল কুদ্দুস এবং সিলেট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (স্বাস্থ্য) কার্যালয়ের প্রধান সহকারী নুরুল হকসহ ২৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, দেখুন ভাই আমি তো ঢাকায় আসিনি, আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। আপনি যদি কোনো কথা বলতে চান তাহলে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। এর বেশি কিছু বলতে নারাজ তিনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন