সহযোগীসহ ইয়াবা বিক্রির সময় গ্রেফতার হয়েছেন মা। কোলে ছিল এগারো মাসের শিশুসন্তান। পুলিশ শিশুসহ মা রাহেলা বেগমকে থানায় নিয়ে আসে। সারারাত থানায় হাজতবাস করে বুধবার (১৩ জানুয়ারি) যখন শিশুসহ রাহেলা বেগমকে আদালতে হাজির করা হয়, আদালত কোলের শিশুসহ রাহেলাকে জেলা হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। বর্তমানে শিশুসন্তানসহ রাহেলা কুড়িগ্রাম জেলা কারাগারে বন্দি রয়েছেন। জেলা কারাগারের জেলার শরিফুল আলম শিশুসন্তানসহ রাহেলা বেগমের কারাবাসের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আদালত সূত্র জানায়, বুধবার (১৩ জানুয়ারি) দুপুরে কুড়িগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আমলি আদালত (ফুলবাড়ী)-এর বিচারক শিশুসহ রাহেলা বেগমকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরে বিকালে তার এগারো মাসের দুগ্ধপোষ্য শিশুসন্তানসহ কারাগারে পাঠায় পুলিশ।
ফুলবাড়ী থানা পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলায় পুলিশের মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে মঙ্গলবার (১২ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় সদর ইউনিয়নের বালাটারী কালিরহাট গ্রামে ১২০ পিস ইয়াবাসহ মোছা. রাহেলা বেগম (৩৫) ও মানিক চন্দ্র মোহন্ত (৩২) নামে দুই মাদক বিক্রেতাকে আটক করে পুলিশ। তাদের মধ্যে রাহেলা বেগমের বাড়ি ফুলবাড়ীর বালাটারী কালিরহাট গ্রামে। সে ওই গ্রামের আনিছুর রহমানের স্ত্রী। আর মানিক চন্দ্র মোহন্ত উলিপুর উপজেলার পান্ডুল ইউনিয়নের বৈরাগিটারী গ্রামের বিশ্বনাথ মোহন্তের ছেলে।
পুলিশ জানায়, রাহেলাকে নিজ স্ত্রী পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সময় ইয়াবাসহ মাদকদ্রব্য পরিবহন করতো মানিক চন্দ্র। পুলিশের চোখ ফাঁকি দেওয়ার জন্য তারা সঙ্গে একটি শিশু রাখত, যাতে কারও সন্দেহ না হয়।
ফুলবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাজীব সরকার জানান, মাদকসহ আটক মানিক চন্দ্র ও রাহেলা বেগমের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দিয়ে আদালতে পাঠানো হলে আদালত তাদের জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এক প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘রাহেলা বেগমের নামে ফুলবাড়ী থানায় আগে কোনও মামলা নেই। এবারই প্রথম সে মাদকসহ আটক হয়েছে।’
এদিকে অভিযুক্ত রাহেলা বেগমের সঙ্গে তার এগারো মাস বয়সের শিশুসন্তানের কারাবাস ওই শিশুর সাংবিধানিক, মৌলিক ও সার্বজনীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল বলে মত দিয়েছেন আইনজীবীরা। দুগ্ধপোষ্য হওয়ায় আদালত শিশুটিকে তার মায়ের সঙ্গে কারাগারে পাঠানোর অনুমতি দিলেও এতে করে ভবিষ্যতে ওই শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মায়ের অপরাধে ছোট্ট ওই শিশুটিও কারাভোগ করায় ভবিষ্যতে তার মনের ওপর এর একটি বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
জানতে চাইলে জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘যেহেতু সে দুগ্ধপোষ্য শিশু তাই মায়ের সঙ্গে থাকার অধিকার তার রয়েছে। আদালত এই জায়গায় তাকে তার মায়ের সঙ্গে থাকার অধিকার দিয়েছেন। তবে অপরাধ যদি গুরুতর না হয়ে থাকে তাহলে নারী হিসেবে আদালতের জামিন বিবেচনার সুযোগ রয়েছে।’
গ্রেফতারের সময় জব্দকৃত মাদকের পরিমাণ উল্লেখ করলে এই আইনজীবী বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারার উপ-ধারার বিধান অনুযায়ী যদি আসামির অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য না হয়, তার পালানোর সম্ভাবনা না থাকে, সে যদি নারী হয় অথবা অসুস্থ হয় কিংবা শিশু হয় তাহলে আদালত জামিন বিবেচনা করতে পারেন। ফলে একটা সুযোগ রয়েছে।’
‘জেলাখানায় থাকলে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে, সে একটা বৈরী পরিবেশে বড় হবে।’ যোগ করেন এই আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী।
সমাজকর্মী ও শিশু অধিকারকর্মীরা বলেছেন, প্রথমবার সংঘটিত অপরাধে দুগ্ধপোষ্য শিশুর অভিযুক্ত মাকে জামিন দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। এতে করে সংশ্লিষ্ট শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে না। তবে কোনও নারী অপরাধ সংঘটনে শিশুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করলে তাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা।
সাবেক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আজিজুর রহমান দুলু জানান, ওই শিশুটি কোনও অপরাধ করেনি। পেনাল কোর্ডের ৮২ ধারা অনুযায়ী ওই শিশু দ্বারা সংঘটিত কোনও অপরাধ আদৌ অপরাধ নয়। সুতরাং কোনও অপরাধ না করেও কারাভোগ করা তার ভবিষ্যৎ মানসিক বিকাশের অন্তরায় হতে পারে।
সাবেক এই বিচারক বলেন, ‘যে অপরাধে শিশুটির মাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে তার সেই অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নয়। মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ না হলে যেকোনও অপরাধে কোনও নারী প্রথমবারের মতো দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও ১৯৬০ সালের ‘দি প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স’ অনুসারে তাকে কারাগারে না পাঠিয়ে প্রবেশনে পাঠানোর বিধান ওই আইনে রয়েছে। ফলে যে নারীকে মৃত্যুদণ্ড ব্যতীত যেকোনও অপরাধে (প্রথমবার) দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরও কারাগারে না পাঠিয়ে প্রবেশনে দেওয়া যেতে পারে সেই নারীকে সেই অপরাধে তার দুগ্ধপোষ্য শিশুর সাংবিধানিক, মৌলিক ও সার্বজনীন মানবাধিকার বিবেচনা করে জামিন দেওয়া যেত। এতে করে ওই শিশুর ভবিষ্যৎ অধিকারগুলো সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন