নিজেকে ‘নবাবের নাতি’ পরিচয় দিয়ে প্রতারণার জাল বিস্তারকারী আলী হাসান আসকারীর সঙ্গে তার পাঁচ সহযোগীকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ; কিন্তু তার মধ্যে তিনজন যে আসকারীরই ভাই তা পুলিশও জানত না।
তাদের গ্রেপ্তার করার ২০ দিন পর তা জানতে পেরে পুলিশ কর্মকর্তারাও অবাক হয়েছেন।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার তৌহিদুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, কামরুলের সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া বাকি পাঁচজনের মধ্যে তিনজনই যে কামরুলের ভাই, তা বোঝা যায়নি।
“তাদের কাছে জানতে চাইলেও কেউ মুখ খোলেনি। পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে যে গ্রেপ্তার হওয়াদের মধ্যে রাজা, রানা ও আহম্মদ তার ভাই।”
এলাকাবাসীও জানত না আসকারীর ভাইদের সম্পর্কে। তারা ওই তিন ভাইকে কামরুলের দেহরক্ষী, ব্যক্তিগত সচিব, ম্যানেজার হিসেবে চিনত। আর তারাও প্রকাশ্যে আশকারীকে ‘স্যার’ বলত।
গত ২৮ অক্টোবর আলী হাসান আসকারীর (৪৮) সঙ্গে গ্রেপ্তার হন রাশেদ ওরফে রহমত আলী ওরফে রাজা (৩৪), মীর রাকিব আফসার (২০), মো. সজীব ওরফে মীর রুবেল (৩৩), মো. আহম্মদ আলী (৩৮) ও মো. বরকত আলী ওরফে রানা (৩২)।
এর মধ্যে রাজা, আহম্মদ আলী ও রানা আশকারীর ভাই বলে পুলিশ শনাক্ত করেছে।
আর আসকারী আসল নাম কামরুল হাসান হৃদয় বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তারা চার ভাই মিলে গড়ে তুলেছিল প্রতারণা চক্র, আর সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।
কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের ইকোনোমিক ক্রাইম এন্ড হিউম্যান ট্রাফিকিং বিভাগ কোটি কোটি টাকার প্রতারণার অভিযোগে ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি মামলার সূত্র ধরে তাদের গ্রেপ্তার করে।
এর মধ্যে চক্রের ‘হোতা’ আসকারী নিজেকে নবাব সলিমুল্লাহ খাঁনের নাতি হিসেবে পরিচয় দিতেন। বলতেন, দুবাইয়ে আছে তার সোনার কারখানা, তার বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, তারা থাকেন নিউ ইয়র্কে।
এছাড়া সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের মালিকানা রয়েছে বলেও ফেইসবুকে প্রচার চালাতেন তিনি। ফেইসবুকে নিজের সঙ্গে মন্ত্রী-এমপিসহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তুলে তা ব্যবহার করতেন প্রতারণার কাজে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলেন, আসকারী এসব প্রতারণা করতে এবং নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চলতেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে।
উপ-কমিশনার তৌহিদুল বলেন, “তার সব পরিচয়ই ভুয়া। সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করাই তার পেশা। প্রতারণা করে প্রায় ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।”
তিনি বলেন, আসকারীর প্রকৃত পরিচয় খুঁজতে গিয়ে কামরাঙ্গীর চর থেকে তার বাবা আব্দুস সালামকে এনে মুখোমুখি করার পরই জানা যায় আসল পরিচয়।
“কামরুল তার আসল পরিচয় শুরু থেকেই গোপন করে আসছিল। তার আসল নাম কামরুল হাসান হৃদয়। সে নিজের ও বাবার নাম পরিবর্তন করে হয়েছিল নবাব সলিমুল্লাহর নাতি।”
পুলিশ জানতে পেরেছে, ১৯৪৭ সালে আসকারী বা কামরুলের দাদা লোকমান হোসেন পুরান ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করে। বর্তমানে তারা বাবা সালাম দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে থাকেন কামরাঙ্গীরচরে। সেখানে তার ছোট ছেলে আমিনুল ইসলামও থাকেন।
কামরুল শুধু নিজের নামই নয়, স্ত্রীর নামও পরিবর্তন করেছে, যা পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
আসকারীর চালচলন দেখে পুরান ঢাকার অনেকে তাকে নবাবের নাতিই মনে করতেন।
মারুফ নামে একটি ব্যক্তি তার মোবাইলে আসকারীর সঙ্গে তার ছবি দেখিয়ে বলেন, “কী বলেন? এই লোক কিভাবে এই প্রতারণার ফাঁদ পাতল?
“আমাদের এলাকায় আসত, দেখতাম মানুষকে দানও করত। ভেবেছিলাম এই করোনাভাইরাসের সময় তাকে এলাকায় এনে দুস্থদের জন্য দান করাব। কিন্তু এমন প্রতারক!”
পুলিশ কর্মকর্তা তৌহিদুল বলেন, বিভিন্ন ধরনের তদবির থেকে শুরু করে বিদেশে লোক পাঠানোসহ নানাভাবে মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতেন আসকারি।
দুদফা পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের পর চার ভাইই এখন কারাগারে রয়েছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন