ভাইরাসজনিত যেকোনো মহামারির ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে এবং চলতি করোনাভাইরাস মহামারিতে প্রত্যাশিত সময়েরও আগে ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন অনুমোদন পাওয়ার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। একদিকে বিজ্ঞানীরা বিষয়টি নিয়ে যেমন উচ্ছ্বসিত, আবার আছে হতাশাও। আপাতত এই টিকার বাংলাদেশে দেখা পাওয়ার সুযোগ মিলছে না বলেও মনে করছেন অনেকেই। তবে কেউ কেউ সরকারকে এই টিকার তাপমাত্রাজনিত কাঠামো প্রস্তুতে মনোযোগী হতে আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, এখন পাওয়া যাক বা যখনই পাওয়া যাক—অবকাঠামো তৈরি করে রাখা জরুরি। কারণ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কেউ নিশ্চিত হতে পারছেন না—ঠিক কোন টিকা সবার আগে দেশে আনা সম্ভব হবে কিংবা কোনটার আগে কোনটা আসবে। যদিও এখন ফাইজারের টিকার জন্য সরকারের তরফ থেকে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। মডার্নাসহ অন্যগুলোর ব্যাপারেও কাজ চলছে।
টিকা চলে আসার বিষয়টি করোনা প্রতিরোধে বিরাট সাফল্য বলে বিবেচিত হলেও অনেকে একই সঙ্গে বলেছেন, তার পরও সতর্ক থাকতেই হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও করোনা টিকাসংক্রান্ত টাস্কফোর্সের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফাইজারের সঙ্গে আমরা আগে থেকেই যোগাযোগ রাখছিলাম। কিন্তু চ্যালেঞ্জ ছিল তাপমাত্রা। তবে ছোট পরিসরে এটি ব্যবস্থাপনা অসম্ভব নয়। সমস্যা হচ্ছে, সরকারিভাবে আমরা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর জন্য ভাবছি, ফলে অল্প ব্যবস্থা নিয়ে ভাবা ঠিক নয়। এ ছাড়া দামও একটা ব্যাপার। ফাইজারের একটি টিকার দাম দিয়ে আমরা অন্য টিকার কয়েক গুণ কিনতে পারব, যা বেশি মানুষের উপকারে আসবে।’ তিনি আরো বলেন, বেসরকারিভাবে কেউ আনলে আনতে পারে, কিন্তু এসংক্রান্ত নীতিমালা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একাধিক বিজ্ঞানী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের টিকাকেন্দ্রিক নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কিছুটা এলোমেলো অবস্থা রয়েছে। যেমনটা ছিল করোনার শুরুর দিকে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে। অর্থাৎ আমরা যখন জানতে পারছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই মডার্নাসহ আরো একাধিক টিকার অনুমোদন চলে আসবে, তখন আমাদের এখানে টিকাসংশ্লিষ্ট পরিকল্পনায় যুক্ত ব্যক্তিরা এক ধরনের সংকুচিত অবস্থায় থাকছেন। তাঁরা ঠিকমতো পরামর্শও নিচ্ছেন বলে মনে হয় না। এ নিয়ে পরে সরকার বড় ধরনের এক ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছে বলেই মনে হয়।’
বিশেষজ্ঞরা এটাও বলছেন, ফাইজারের টিকা এখনই বাংলাদেশের উপকারে না এলেও পরোক্ষভাবে উপকার রয়েছে। যেখানেই এটা প্রয়োগ হবে সেখানে তো অন্য টিকার চাহিদা কমবে। ফলে অন্য টিকাগুলো বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য সুযোগ বাড়িয়ে দেবে।
অণুজীব বিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. সমীর সাহা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সবার আগে অভিনন্দন জানাতেই হবে ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা অনুমোদন পাওয়ায়। আমাদের দেশে এই টিকা সুবিধা না দিলেও বিশ্বের একজন মানুষ হিসেবে যেখানেই এই টিকা ব্যবহার হবে সেই মানুষগুলো যে সুরক্ষা পাবে এটা অনেক বড় ব্যাপার।’
তিনি বলেন, ‘আমরা অক্সফোর্ডের টিকা নিয়ে অনেক আশাবাদী ছিলাম সবার আগে এটা পাব বলে। কিন্তু নানা জটিলতায় সেটা পিছিয়ে যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য হতাশার। অন্যদিকে ফাইজারের পরই আশার আলো হয়ে দ্রুত আসছে মডার্নার টিকা। ফাইজারের টিকা বাংলাদেশে ব্যবস্থাপনা অনেকটা কঠিন হলেও মডার্নার টিকা কিন্তু তুলনামূলক সহজ। ফলে আমাদের এখন সেদিকে নজর রাখা উচিত, যোগাযোগ বাড়ানো উচিত।’
ভাইরোলজির অধ্যাপক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৈশ্বিক দৃষ্টি থেকে খুবই খুশির খবর। কিন্তু এতে আমাদের দেশের লাভটা কী হবে। আমরা তো এই টিকার আশা ছেড়ে দিয়ে বসে আছি, কেবলই শুনছি এই টিকা আমাদের জন্য উপযোগী নয়। আমি বলছি কথাটি ঠিক না। উপযুক্ত তাপমাত্রার কাঠামো আমরা কেন তৈরি করতে পারছি না? এটা তো অসম্ভব নয়। কেবল পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির অভাবেই আমরা আগেভাগে হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছি।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. সামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রথম দিকেই ফাইজারের টিকার ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকেও যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তাপমাত্রার কারণে কিছুটা পিছিয়ে আসা হয়। এখন আবার যোগাযোগ হচ্ছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত হলে আমরা নিচের দিকে যা যা করণীয় সেটা করার জন্য প্রস্তুত আছি। এ জন্য অনেকটা চ্যালেঞ্জ থাকলেও তা কিভাবে ওভারকাম করা যাবে সেটা নিতে হবে।’
ড. সমীর সাহা বলেন, ‘এখনই ফাইজারের টিকা সরাসরি আনার সুযোগ না পেলেও যারা এখন এই টিকা পাবে তাদের মধ্যে অন্য টিকার চাহিদা থাকবে না। ফলে অন্য টিকার ওপর আমাদের মতো দেশের সুযোগ বাড়াবে। এটাকেই ইতিবাচক হিসেবে দেখতে হবে।’
ডা. সামসুল হক বলেন, ‘এখন অক্সফোর্ডের টিকা দেশে এলে কিভাবে ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যাবে সেগুলো নিয়েই আমরা রাত-দিন কাজ করছি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন