চলনবিলসহ পাবনার ভাঙ্গুড়া ও চাটমোহরের বিভিন্ন বিলে এখন চলছে বাউতদের ‘পলো উৎসব।’ কয়েক দিন ধরেই শৌখিন মৎস্য শিকারিদের পদচারণায় মুখর বিলপাড়। এক সময়ের মৎস্য ভাণ্ডার খ্যাত চলনবিলে এখন মাছের আকাল থাকলেও বাউতদের (শৌখিন মৎস্য শিকারি) আনন্দের কমতি নেই।
‘চলো পলো নামি’ বলে দলে দলে বাউত নামছেন বিভিন্ন খাল-বিলে। তাদের পলোতে কম-বেশি বাহারি জাতের সব মাছ ধরা পড়ছে। বিলে মাছ ছেড়ে উৎসবটি জমজমাট করার পরিকল্পনা করছে চাটমোহর উপজেলা প্রশাসন।
চলনবিল এলাকার বিলকুড়ালিয়া, খলিশাগাড়ি, বড়বিলা, জিয়লগাড়ি, সানকিভাঙ্গা বিল, গুমানী ও চিকনাই নদীতে মাইলের পর মাইল এলাকাজুড়ে কয়েকশ বাউত প্রতিদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত পলো নিয়ে মাছ ধরতে নামছেন। এ যেন হারিয়ে যাওয়া উৎসব নতুন করে ফিরে পাওয়া।
এলাকায় রীতিমতো মাইকিং করে খাল-বিলের পাড়ে ভোর না হতেই বিভিন্ন রকম ‘ধ্বনি’ দিয়ে পলো হাতে বাউতদের নামতে দেখা যাচ্ছে। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও আবার গলা পানিতে নেমে মাছ ধরছেন শৌখিন মৎস্য শিকারিরা। কিছু বাউত চলনবিল পাড়ে আত্মীয় বাড়িতেই রাত কাটাচ্ছেন। সব মিলিয়ে এখন বিলপাড়ে এক ধরনের উৎসব আমেজ বিরাজ করছে।
বুধবার (২ ডিসেম্বর) ভাঙ্গুড়া উপজেলার মন্ডুতোষ ইউনিয়নের রুহুল বিলে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, বর্ষার পানি নেমে যাওয়ায় অনেকটাই পানিশূন্য বিল বুক চিতিয়ে দিয়েছে। মূল বিল ও খালে কিছু পানি অবশিষ্ট রয়েছে। এ সময়ই এ এলাকার শৌখিন মানুষেরা যোগ দিয়েছেন গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ‘পলো উৎসবে।’
ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই বিল অভিমুখে মানুষের ঢল। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ জড়ো হচ্ছে এক স্থানে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষের উপস্থিতিতে বিলপাড়ে তৈরি হয় উৎসবমুখর পরিবেশ। এরপর দল বেঁধে বিলের পানিতে নেমে মাছ শিকারের আনন্দে মেতে ওঠেন তারা। এ উৎসবে পাবনা, নাটোর, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষ আসছেন।
এদের হাতে পলো, চাক পলো, নেট পলো, ঠেলা জাল, বাদাই জাল, লাঠি জালসহ মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম চোখে পড়ে। বিলপাড়ে সমবেত হওয়ার পর একসাথে বিলে নেমে মাছ ধরার আনন্দ উৎসবে মেতে উঠছেন শিশু-কিশোর, যুবক, বৃদ্ধসহ নানা বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ।
মাছ পাওয়া না পাওয়া তাদের কাছে বড় কথা নয়, ব্যতিক্রমী এ উৎসবে যোগ দিয়ে আনন্দ উপভোগই যেন তাদের কাছে মুখ্য। অনেকেই বোয়াল, রুই-কাতল, শোল মাছ শিকার করে বাড়ি ফিরেছেন আনন্দের সঙ্গে।
এ উৎসবে যোগ দিতে আসা ঈশ্বরদীর ৫৫ বছর বয়সী ময়েজ উদ্দীন জানান, পলো দিয়ে মাছ ধরা তার দীর্ঘদিনের শখ। তাই শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতি বছর চলনবিলের রুহুল বিলে চলে আসেন। তবে আগেকার তুলনায় দেশি প্রজাতির মাছ কমে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
নাটোর জেলা থেকে আগত মৎস্য শিকারি আবু বক্কার বলেন, মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বাউতদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেই প্রতি বছর মাছ শিকার করতে আসি। মাছ পাই আর না পাই এটি বড় নয়, বড় হলো শখ।
বড়াইগ্রামের আফসার আলী মাছ না পেয়ে হতাশার সুরে বলেন, এখানকার লোকজন আগের রাতে জাল দিয়ে মাছ মেরে নিয়েছে। এখন আর তেমন মাছ নেই এই বিলে।
পাবনা সদর উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামের মোজাহার আলী, চাটমোহরের দাঁথিয়া গ্রামের এনামুল হক, বোয়ালমারী গ্রামের আনিসুর রহমান ও বেলাল হোসেনসহ অন্য বাউতরা জানান, হাজার হাজার মানুষ একসাথে মাছ ধরার আনন্দই আলাদা। মাছ সবাই পায় না। একজন পেলে আনন্দ ভাগাভাগি করেন সবাই। কে মাছ পেল আর কে পেল না তা নিয়ে কোনো দুঃখ নেই কারো।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল মতিন জানান, উন্মুক্ত জলাশয়ে শৌখিন মৎস্য শিকারিরা প্রতি বছরই মাছ শিকার করেন। উন্মুক্ত জলাশয়গুলোতে যেন মাছ থাকে সেজন্য প্রতি বর্ষা মৌসুমে উন্মুক্ত জলাশয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়।
এ ব্যাপারে চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈকত ইসলাম জানান, বাউত বা পলো উৎসব গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। দেশের অন্যান্য এলাকায় এ উৎসব প্রায় বিলুপ্তির পথে। এ এলাকায় ঐতিহ্যটি এখনও টিকে আছে।
তিনি বলেন, বড়বিল, ডেঙ্গারবিল, খলিশাগাড়িবিল, রহুলবিল, ডিকশীবিলসহ অন্যান্য বিলে বাউতরা মাছ ধরছেন। এ উৎসবটিকে জমজমাট করতে বিলে মাছ থাকা প্রয়োজন। এজন্য বর্ষার আগে বিলে মাছ ছেড়ে বর্ষার পর উৎসবটিকে ধরে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। এজন্য তিনি পার্শ্ববর্তী বিল প্রধানসহ কয়েকটি উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন