কুসংস্কারে ঘেরা সামাজিক সমস্যায় জর্জরিত একটা সমাজে আমরা বসবাস করি। যেখানে সামাজিক সমস্যাগুলো আমাদের জীবনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ভয়াবহ ফলাফল আমরা উপলব্ধি করলেও এই নিয়ে আমাদের উদ্যোগ সীমিত। এসব সামাজিক সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো যৌতুক প্রথা। যদি বলা হয় এটা আমাদের সমাজে হঠাৎ করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তাহলে ভুল হবে।
‘কেন আমরা প্রতিবাদী হবো না? আর কত কুপ্রথার বলি হবে মেয়েরা । শক্ত হাতে প্রতিবাদ প্রয়োজন। মেয়েদের ভোগ-বিলাসের পণ্য না ভেবে মানুষ ভাবতে হবে। পরিবারকে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে যাতে যৌতুকের অভিশাপ তাদের স্পর্শ করতে না পারে। সমাজে যারা অনেকগুলো ডিগ্রি অর্জনের সার্টিফিকেট নিয়ে শিক্ষিত হওয়ার বড়াই করে তাদেরকে মনের দিক থেকে শিক্ষিত হতে হবে তবে তারা যৌতুককে "না" বলতে পারবে।’
যৌতুক প্রথা অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। কিন্তু যৌতুক এখন সামাজিক ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাজার-হাজার মেয়েরা প্রতিনিয়ত সহ্য করছে অমানুষিক নির্যাতন। শুধু একটি মেয়ে নয় বরং গোটা পরিবার ভুক্তভোগী হয়। যৌতুক দেওয়া নেওয়া যেন একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে যার প্রেক্ষিতে স্বামীর ঘরে স্ত্রীর মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এমনটা ভেবে থাকা হয়। এমন ভাবনা নিয়ে বেড়ে ওঠা সমাজকে ধিক্কার জানানো উচিত।
যৌতুক প্রথাটি নারী সমাজের প্রতি হীনম্মন্য ভাব পোষণের জন্য উৎপত্তি হয়েছে। আমাদের সমাজে এক শ্রেণির মানুষ আছে যাদের থেকেই মূলত এই যৌতুক প্রথার উদ্ভব হয়েছে । বর্তমানে এর ভয়াবহতা বাড়লেও এই প্রথার প্রচলন প্রাচীনকাল থেকেই। যদি পুরনো ইতিহাসের দিকে তাকায় তাহলে দেখতে পাব তখন নিচু বংশের মেয়েকে উচ্চ বংশের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে হলে মেয়ের বাবাকে পাত্রপক্ষকে প্রচুর অর্থ সম্পদ দিতে হতো। এমন পরিস্থিতি এখনো বিদ্যমান। এটা যে শুধু একটা মেয়েকে নিচু করা নয় বরং সমগ্র নারী জাতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা।
নারীর প্রতি সহিংসতা কত রকম ভাবে হতে পারে সেটা কি আমরা ভেবে দেখেছি? বরং আমরা তাদের সহিংসতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছি। সমাজ আজ তাদের কাছে ভয়ের কারণ। আমাদের সামনে যৌতুকের কুফল একদম আলোর মতো পরিষ্কার তবুও আমরা অন্ধকারে আছি। সেইসাথে অন্ধকার করে রেখেছি প্রতিটি মেয়ের জীবন। আমরা একদিকে নারী জাতিকে উন্নতির চরম শিখরে উঠে যাওয়ার আহ্বান জানায় আর অন্যদিকে যৌতুক প্রথার মত সামাজিক ব্যাধি দ্বারা তাদের পায়ে শিকল বেঁধে রাখি।
এখন আসা যাক এই সামাজিক ব্যাধি কারণগুলোতে। আমরা মানব জাতি "অর্থ লোভ" একটা বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের । অর্থের লোভে পড়ে অনেকে যৌতুক নেওয়ার মতো ঘৃণ্য অপরাধ করে থাকে। মেয়েদেরকে ছোট করে দেখার মানসিকতা ও যৌতুকের জন্য দায়ী। নারীকে আমরা কেন পুরুষের সমতুল্য ভাবতে পারিনা? ভাবতে পারি না, কারণ আমরা ভাবতে চাই না ।
কেন মেয়েদেরকে যৌতুকের অর্থের বিনিময়ে পরিমাপ করতে হবে? একটা ছেলের সবকিছু নিখুঁত আর মেয়ের খুঁত ঢাকতে কন্যাপক্ষকে গুণতে হয় যৌতুকের পরিমাণ। আসল সমস্যা আমাদের মনে যেখান থেকে এই কুপ্রথা গোটা সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। কন্যার পিতা মাতা শ্বশুর বাড়িতে মেয়ের সুখের জন্য বা সম্মান বৃদ্ধি করতে যৌতুক দিয়ে থাকে। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভাবে ভুল। যৌতুক কখনোই নারীর সম্মান বৃদ্ধি করে না বরং আত্মমর্যাদা কমিয়ে দেয়। এই সামান্য বোধটুকু যদি আমাদের থাকতো তাহলে সমাজ থেকে অনেক আগেই এই ব্যাধি দূর হয়ে যেতো। লক্ষণীয় বিষয় হলো উন্নত সমাজ ব্যবস্থার সাথে সাথে যৌতুকের পরিমাণটাও অনেক এগিয়ে গেছে। টাকা ছাড়াও দামি আসবাবপত্র, উচ্চমানের বাড়ি, গাড়ি এখন দাবি করা হয় । এগুলো না দিতে পারলে সহ্য করতে হয় অমানবিক নির্যাতন। অত্যাচার করেই ক্ষান্ত হন না বরং হত্যা করা হয়। অনেকে এসব নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। এমন ভয়াবহ পরিণতির কথা জেনেও আমরা যৌতুক দেওয়া নেওয়া থেকে পিছিয়ে আসতে পারছি না।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেব অনুযায়ী ২০১৬ সালে যৌতুকের কারণে ১২৬ জন নারীর ওপর নির্যাতন চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়। ১০৮ জন নির্যাতনের শিকার হয়েও বেঁচে আছেন । ২০১৫ সালে ১৮৭ জন নারীকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছিল। আমাদের দেশে ৮৭ ভাগ মেয়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তার সিংহভাগই হচ্ছে যৌতুকের কারণে। গ্রামবাংলার প্রেক্ষাপট থেকে দেখা যায় অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেয়ার কারণে অনেকে যৌতুকের শিকার হচ্ছে দারিদ্রতার কারণে অল্প বয়সী মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চান পিতা-মাতা। কিন্তু যৌতুকের বিষাক্ত ছোবলে সব কিছু হারিয়ে ফেলেন তারা। ইউনাইটেড ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনপি) পরিচালিত "সিস্টেম অফ ডাওরি ইন বাংলাদেশ" এর উপর ১০ বছরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শতকরা ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়।
এভাবে অন্তরালে কত মেয়েকে নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে। মেয়ের ওপর নির্যাতন বেড়ে যাবে এই ভয়ে পিতা-মাতা চুপ করে সহ্য করছে। যৌতুক প্রথা এখন একটা নীরব ব্যাধির মতো হয়ে গেছে যেখানে আমরা সবাই জানি প্রতিনিয়ত কি ঘটে চলেছে আমাদের আশেপাশে তবুও নীরবে আমরা মেনে নিচ্ছি এই অন্যায়। শিক্ষিত সমাজে শুধু নারীদের শিক্ষিত করলেই চলবে না তাদেরকে যথাযথ সম্মান দিতে হবে।
যে প্রথার শুরুটা আমরা করেছি তার শেষটাও আমরাই করতে পারি। তার জন্য আমাদের মাঝে সামাজিক, নৈতিক, মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। ১৯৮০ সালে যৌতুক বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে তবে তার যথাযথ প্রয়োগের অভাব রয়েছে বলেই যৌতুকের সামাজিক প্রেক্ষাপট এত খারাপ। এজন্য আইনের প্রয়োগ করতে হবে। ১৯৮৬ সালের যৌতুক নিরোধ আইন সংশোধন করা হয়েছে । তবে পরিবার থেকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। কোনভাবেই ভাবা যাবে না যৌতুক নারীর সম্মান বৃদ্ধি করে বরং এটা তাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান তখনই বৃদ্ধি পাবে যখন আমরা নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পারবো। আমাদের বুঝতে হবে অর্থলোভের থেকে একটা জীবন অনেক দামী।
আমাদেরকে সামাজিকভাবে সচেতন হতে হবে। নির্যাতনের ঘটনা আমাদের আশেপাশে চোখের সামনে ঘটছে। তাহলে কেন আমরা প্রতিবাদী হবো না? আর কত কুপ্রথার বলি হবে মেয়েরা । শক্ত হাতে প্রতিবাদ প্রয়োজন। মেয়েদের ভোগ-বিলাসের পণ্য না ভেবে মানুষ ভাবতে হবে। পরিবারকে মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে যাতে যৌতুকের অভিশাপ তাদের স্পর্শ করতে না পারে। সমাজে যারা অনেকগুলো ডিগ্রি অর্জনের সার্টিফিকেট নিয়ে শিক্ষিত হওয়ার বড়াই করে তাদেরকে মনের দিক থেকে শিক্ষিত হতে হবে তবে তারা যৌতুককে "না" বলতে পারবে।
লেখক : শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন