বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের বিপণন প্রতিষ্ঠান ‘মেঘনা পেট্রোলিয়াম’র বিপণন করা ফার্নেস অয়েলে মাত্রাতিরিক্ত পানির অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে। শুধু তাই নয়, মাত্রাতিরিক্ত পানি থাকায় ফেরত আসা ১০ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল পরিশোধন ছাড়াই নিজেদের মূল ট্যাংকারে মেশানোর অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) সেখ আবদুল মতলেবের মতলববাজিতেই এমন পুকুর চুরির ঘটনা ঘটছে। দেখার যেন কেউ নেই!
সম্প্রতি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা মেঘনা পেট্রোলিয়াম ডিপো থেকে ১০ লাখ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে ‘ওটি ওশান স্টার’ নামের একটি জাহাজ পাঠানো হয় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টে। কিন্তু সেখানকার কর্মকর্তারা মেঘনা পেট্রোলিয়ামের পাঠানো ফার্নেস অয়েল পরীক্ষা করে তাতে মাত্রাতিরিক্ত পানির অস্তিত্ব পান। ওই ফার্নেস অয়েলে পানির পরিমাণ ছিল ০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা কোনোভাবেই বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের উপযোগী নয়। এ কারণে তারা ফার্নেস অয়েলবাহী জাহাজ ‘ওটি ওশান স্টার’ আবারও চট্টগ্রামের মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ডিপোতে ফেরত পাঠান।
বিষয়টি স্বীকার করে বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের স্টোরকিপার জাহাঙ্গীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘চট্টগ্রামের মেঘনা ডিপো থেকে ফার্নেস অয়েল নিয়ে একটি জাহাজ আসছিল। কিন্তু নিয়ে আসা ফার্নেস অয়েল আমাদের ল্যাবে পরীক্ষা করে তাতে মাত্রাতিরিক্ত পানি পাওয়া যায়। এ কারণে আমরা জাহাজটি আবারও ফেরত পাঠিয়েছি।’
jagonews24
চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ৪নং জেটিতে নোঙর করা ফার্নেস অয়েলবাহী জাহাজ ‘ওটি ওশান স্টার’
তিনি জানান, বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের ল্যাবে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের বিপণন করা ফার্নেস অয়েলের চারটি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে একটি নমুনার ফলাফল ছিল ০ দশমিক ৮ শতাংশ, অপরটির ০ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া বাকি দুটি ছিল ০ দশমিক ৪৩ এবং ০ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
জাহাঙ্গীর বলেন, ‘চারটি নমুনার দুটিতেই অনেক বেশি পানি থাকায় আমরা ওই ফার্নেস অয়েল নিতে পারিনি। আমরা ০ দশমিক ৫ পর্যন্ত পানি নিতে পারি, কিন্তু একটি থেকে নিতে গেলে তারা যে অন্য একটি থেকে আমাকে তেল দেবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?’
সেখ আবদুল মতলেবের ‘মতলববাজি’
অনুসন্ধানে জানা যায়, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) মীর সাইফুল্লাহ আল খালেদ অসুস্থ হয়ে বিশ্রামে থাকার সুযোগে জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) সেখ আবদুল মতলেব ফার্নেস অয়েলের নামে পানির এ ব্যবসা পেতেছেন। আর্থিক সুবিধা নেয়ার মাধ্যমে সেখ আবদুল মতলেব নিজের পছন্দের জাহাজে করে গ্রাহকদের তেল সরবরাহ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিসাধন ও সুনাম নষ্ট করছেন।
বারবার নিষেধ সত্ত্বেও জাহাজ ‘ওটি ওশান স্টার’কে ট্রিপ দেয়ার বিষয়ে বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের স্টোরকিপার জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সত্যি বলতে কী, এর আগেও তাদের ফার্নেস অয়েলে আমরা পানি পেয়েছি, প্রচুর পানি। এছাড়া জাহাজটা (ওটি ওশান স্টার) নিয়ে আমাদের আগে থেকেই আপত্তি ছিল। এটা (ওটি ওশান স্টার) না পাঠানোর জন্য আমরা বারবার নিষেধ করছিলাম, কিন্তু তবুও পাঠানো হয়।’
ঘটনা ধামাচাপা দিতে গিয়ে জাতীয় সর্বনাশ করছেন মতলেব
বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের ফার্নেস অয়েলে মাত্রাতিরিক্ত পানি পাওয়ার ঘটনা ধামাচাপা দিতে নতুন কারসাজি সাজিয়েছেন সেখ আবদুল মতলেব। ‘ওটি ওশান স্টার’ জাহাজের মালিক, জাহাজের মাস্টার ও সুপারভাইজারের যোগসাজশে তিনি মাত্রাতিরিক্ত পানি মেশানো ওই ফার্নেস অয়েল আবারও মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মূল ট্যাংকারে মেশানোর ব্যবস্থা করেন। এর মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানে মজুত সব ফার্নেস অয়েলেই পানি মেশানো হলো। ফলে ভবিষ্যতে যেসব প্রতিষ্ঠান এসব ফার্নেস অয়েল তাদের মেশিনারিজ চালানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করবে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সর্বোপরি ব্যক্তির লাভে ক্ষতিগ্রস্ত হবে পুরো দেশ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১২ নভেম্বর চট্টগ্রামের মেঘনা পেট্রোলিয়াম জেটি থেকে জাহাজ ‘ওটি ওশান স্টার’ ফার্নেস ওয়েল নিয়ে ১৮ নভেম্বর বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট জেটিতে পৌঁছায়। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষায় ফার্নেস অয়েলে অতিরিক্ত পানির অস্তিত্ব পাওয়া গেলে তারা জাহাজটি আবারও চট্টগ্রামে ফেরত পাঠান।
নিয়ম অনুযায়ী, ফার্নেস অয়েলে অতিরিক্ত পানির অস্তিত্ব পাওয়া গেলে তা চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে পরিশোধন করে নিতে হয়। কিন্তু মেঘনা পেট্রোলিয়ামের জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) সেখ আবদুল মতলেব ‘ওটি ওশান স্টার’ জাহাজের মালিক, জাহাজের মাস্টার ও সুপারভাইজারের যোগসাজশে পানিমিশ্রিত ফার্নেস অয়েল গত সোমবার (২৩ নভেম্বর) মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মূল ট্যাংকারে ভর্তি করেন। এতে প্রতিষ্ঠানটিতে মজুত সব ফার্নেস অয়েলে পানি মিশ্রণের ফলে এর গুণগত মানের অবনতি হলো বলে অভিমত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
সরেজমিনে মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ৪নং জেটিতে গিয়ে দেখা যায়, ফার্নেস অয়েলবাহী ‘ওটি ওশান স্টার’ জাহাজটি নোঙর করা। এ সময় জেটিতে কর্মরতরা এই প্রতিবেদককে জানান, গতকাল রাতে এই জাহাজ থেকে ফার্নেস অয়েল খালাস করা হয়েছে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মূল ট্যাংকারে।
মাত্রাতিরিক্ত পানিমিশ্রিত ফার্নেস অয়েল মেঘনা পেট্রোলিয়ামের মূল ট্যাংকারে মেশানোর বিষয়টি জাগো নিউজের কাছে স্বীকার করেন প্রতিষ্ঠানের বাল্ক ইনচার্জ রাসেদুল হক। তিনি বলেন, “আমরা গত রাতে সিরাজগঞ্জফেরত ‘ওটি ওশান স্টার’ জাহাজটি রিসিভ করেছি।”
মাত্রাতিরিক্ত পানি থাকার পরও কেন ওই ফার্নেস অয়েল মূল ট্যাংকারে মেশানো হলো— প্রশ্ন করা হলে বাল্ক ইনচার্জ রাসেদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসলে ওই ফার্নেস অয়েলে পানির পরিমাণ মাত্র ০ দশমিক ২ শতাংশ। ওদের (বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট) মেশিনে ত্রুটি আছে। তাই আমরা এই ফার্নেস অয়েল মূল ট্যাংকারে নিয়েছি। এটি একান্তই মেঘনা পেট্রোলিয়ামের বিষয়।’
পুরো ঘটনা চেপে গেলেন মতলেব!
এ বিষয়ে কথা বলতে মেঘনা পেট্রোলিয়ামের জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) সেখ আবদুল মতলেবের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি জাহাজ ‘ওটি ওশান স্টার’ দিয়ে বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য ফার্নেস অয়েল পাঠানো, সেখানে মাত্রাতিরিক্ত পানি পাওয়ায় তা ফেরত পাঠানো এবং পরিশোধন ছাড়াই মূল ট্যাংকারে ফার্নেস অয়েল মেশানোর পুরো বিষয়টি ‘বলতে পারছি না’ বলে এড়িয়ে যান।
মেঘনা পেট্রোলিয়ামের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন) আহসান হাবীব তমাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘হ্যাঁ, বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য পাঠানো ফার্নেস অয়েল ফেরত এসেছে। তেলের কোয়ালিটি ঠিক না থাকায় তারা ফেরত দিয়েছেন।’
এ সময় মাত্রাতিরিক্ত পানিমিশ্রিত ফার্নেস অয়েল পরিশোধনের জন্য ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পাঠানো হয়েছিল কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, আমাদের ট্যাংকে নিয়ে নিয়েছি।’
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পরিচালক (বিপণন) মো. সামসুদ্দোহার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এমন বিষয় সম্পর্কে আমরা মোটেও অবগত নই। আপনার কাছ থেকে জানতে পারলাম। সবচেয়ে ভালো হয় অভিযোগ পেলে। বাঘাবাড়ী ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ যদি আমাদের অভিযোগ করেন, তাহলে আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। মানা করা শর্তেও কেন বারবার একই জাহাজে করে প্রতিষ্ঠানটিকে ফার্নেস অয়েল পাঠানো হচ্ছিল এবং ফেরত আসা ফার্নেস অয়েল মেঘনা পেট্রোলিয়াম কী করেছে, সে প্রশ্ন আমরা তুলব।’
সম্প্রতি দেশজুড়ে নিম্নমানের জ্বালানি তেল সরবরাহের অভিযোগ ওঠে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তিন বিপণন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও যমুনা অয়েল কোম্পানির চারটি ডিপো পরিদর্শন করে বিপিসির তদন্ত টিম। তারা মানহীন অকটেন ও জ্বালানি তেল পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হন। এটা নিয়ে পেট্রোলিয়াম করপোরেশনে তোলপাড় শুরু হয়। ইতোমধ্যে চার ডিপো ইনচার্জকে শোকজ করেছে বিপিসি। পাশাপাশি মানহীন জ্বালানি পাওয়ার বিষয়ে তিন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মতামত চাওয়া হয়েছে বিপিসির পক্ষ থেকে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন