‘কাশি দিলে আমি কি করব? আমার কিছু করার নেই। বুকে বালিশ চাপা দিয়ে কাশি দিতে বলেন' সকালে দেখব এই বলে কর্তব্যরত ডাক্তার ওনার রুম থেকে আর বের হননি। ডাক্তারের সেই সকাল কিন্তু আর আসেনি। সকালের আগেই ভোর রাত ৪টার দিকে মুখে খালি অক্সিজেন সিলিন্ডারের পাইপ লাগানো হতভাগি করোনা আক্রান্ত নারী কহিউর আক্তার মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অক্সিজেনের অভাবে একজন নারীর এমন মৃত্যুকে মেনে নিতে পারছেন না তার স্বজন ও সরকারি কর্মচারী স্বামীর সহপাঠিরা।
কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে গত শুক্রবার রাতে স্থানীয় ডিসি কলেজের নারী অফিস সহকারী ও করোনা রোগী কহিউর আক্তারের চিকিৎসার জন্য তার স্বামীর অনুরোধে কর্তব্যরত চিকিৎসক এমনই জবাব দেন। মৃত্যুর শিকার নারীর স্বামী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের গোপনীয় সহকারী হিসাবে কর্মরত। একজন সরকারি কর্মচারী হিসাবে তার স্ত্রীর মুখে লাগানো অক্সিজেন সিলিন্ডারের অক্সিজেন শেষ হওয়ার কথা বার বার জানালেও চিকিৎসক এবং কর্তব্যরত নার্সরা তা কোনোভাবেই আমলে নেননি বলে তিনি অভিযোগ করেন।
করোনা আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে সরকারি জেলা সদর হাসপাতালটিতে সঠিক চিকিৎসার জন্য একজন স্বামী ২৪ ঘণ্টা ধরে কি রকমের আহাজারি করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে রবিবার সরকারি কর্মচারী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান জেলা প্রশাসকের নিকট লিখিত আবেদন দিয়েছেন। এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন জানিয়েছেন, ‘অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যুর বিষয়ে আমি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। ঘটনাটি অত্যন্ত বেদনার এবং দুঃখজনকও। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
অপরদিকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ডা. শাহিন আবদুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, ‘এরকম মৃত্যুর বিষয়টি আমিও শুনেছি। তবে তদন্ত না করে ঘটনা সত্যি কিনা বলা যাবে না।’
মাত্র কয়েক মাস আগেও কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালটিতে অক্সিজেনসহ অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবের অজুহাতে একের পর এক রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অথচ আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থাসহ জেলা প্রশাসন ও কক্সবাজারের দানশীল মানুষগুলোর মানবিক প্রচেষ্টায় স্বল্প দিনের ব্যবধানেই জেলা সদর হাসপাতালটি চিকিৎসায় স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।
জানা গেছে, গত ২৯ অক্টোবর বৃহস্পতিবার রাতে কহিউর আক্তার করোনা পজিটিভ হয়ে এবং শ্বাসকষ্ট নিয়ে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে অক্সিজেনের অভাবে শুক্রবার ভোর রাত ৪টায় আকস্মিকভাবে তার মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন তার স্বামী মিজানুর রহমান। মৃত্যুকালে হতভাগী কহিউর ১৭ দিনের এক পুত্র সন্তান ও ২ দুই কন্যা সন্তান রেখে গেছেন। স্ত্রী কহিউর আক্তারের এমন মৃত্যুকে ‘ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিযোগ করেছেন তার স্বামী জেলা প্রশাসনের কর্মচারী মিজানুর রহমান। নিহতের স্বামী মিজানুর রহমান ও স্বজনদের অভিযোগ প্রয়োজনীয় অক্সিজেনের অভাবে কহিউর আক্তারের অকাল মৃত্যু হয়েছে।
এদিকে স্বামী মিজানুর রহমান রবিবার কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের কাছে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সদের চরম গাফেলতির কারণেই তার স্ত্রী অকালে মারা গেছেন বলে এক লিখিত আবেদনে অভিযোগ করেন। তিনি এজন্য তদন্ত সাপেক্ষে কঠোর ব্যবস্থা নিতে দাবি জানান। স্বামী মিজানুর আরো জানান, তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে সার্বক্ষণিক হাসপাতালের চিকিৎসা কাজে ছিলেন। যখন তার স্ত্রীর দেহে অক্সিজেনের সংযোজন ছিল তখন তার সিচ্যুরেশন ছিল ৯৬%।
কিন্তু অক্সিজেন শেষ হয়ে গেলে পরবর্তীতে আর একটি অক্সিজেনের বোতল সংযোজন করা হয়। তবে সে বোতলটিতে কোনো অক্সিজেন ছিল না। অথচ পর্যাপ্ত অক্সিজেনও রয়েছে হাসপাতালে। পরবর্তীতে কহিউর আক্তারের অক্সিজেনের সিচ্যুরেশনের মাত্রা দ্রুত হ্রাস পেয়ে ৬০% নেমে আসে। এর ফলে অক্সিজেনের অভাবে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের তীব্রতা বেড়ে গেলে তিনি দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কালেক্টরেট সহকারি সমিতির নেতৃবৃন্দ জানান, কক্সবাজার সদর হাসপাতালে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় গত আগস্ট মাসে করোনা চিকিৎসার জন্য আইসিইউ, এইচডিইউ, হাইফ্লো নাজাল, ভ্যান্টিলেটর, সেন্ট্রাল অক্সিজেন প্ল্যান্ট উদ্বোধন করা হয়। ওই দিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জেলাবাসীকে আশ্বস্ত করেন, আর কোনো রোগী অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে না। কিন্তু হাসপাতালের কর্মরত ডাক্তারদের অবহেলার কারণে আজ এক স্বামী তার স্ত্রীকে এবং তিন শিশু তার মাকে হারাল।
এদিকে কক্সবাজার ডিসি কলেজের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর কহিউর আক্তারের মৃত্যুর প্রতিবাদে এবং সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক শাস্তির দাবিতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জেলা কালেক্টরেট সহকারী সমিতি। সমিতির সদস্যরা জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন জানিয়ে কহিউর আক্তারের মৃত্যুর জন্য দায়ি জেলা সদর হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের শাস্তি দাবি করেছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন