কারসাজি বন্ধে স্টক এক্সচেঞ্জের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ
শেয়ারবাজারের সুশাসন প্রতিষ্ঠান স্টক এক্সচেঞ্জের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। বিশেষ করে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সামনেই বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশেই শেয়ারবাজারে কারসাজির বিরুদ্ধে স্টকএক্সচেঞ্জ সবার আগে ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু ডিএসইর ব্রোকাররা কারসাজি করলে স্টক এক্সচেঞ্জ নিরব। এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এছাড়াও শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
শেয়ারবাজার নিয়ে শনিবার এক ওয়েবিনারে বক্তারা এসব মন্তব্য করেন। ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) এবং বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) যৌথভাবে ওয়েবিনারের আয়োজন করে।
এতে প্রধান অতিথি ছিলেন- প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (এফবিসিসিআই) সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ।
মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান। স্বাগত বক্তব্য দেন বিএমবিএ সভাপতি মো. ছায়েদুর রহমান ও সিএমজেএফের সভাপতি হাসান ইমাম রুবেল।
সালমান এফ রহমান বলেন, বর্তমানে পুঁজিবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী কম। ৮০-৮৫ শতাংশই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা লেনদেন করে। এটা বড় দুর্বলতা। আর মিউচুয়াল ফান্ডের অংশ ৩ শতাংশ বলা হলেও লেনদেন আরও কম। আইসিবি ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নেই বললেই চলে। কিন্তু একটি বাজারতো একমাত্র আইসিবি দিয়ে চলতে পারে না।
সালমান এফ রহমান বলেন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) সামনেই উৎপাদনহীন ও কারখানা বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ারে কারসাজি হচ্ছে। কিন্তু ডিএসই কিছুই করছে না। সবাই দেখছে একটি কোম্পানির ১০ বছর ধরে কারখানা ও উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। প্রতিনিয়তই এই রকম কোম্পানির শেয়ার নিয়ে ডিএসইর ব্রোকাররা কারসাজি করছে। ডিএসইর সামনেই বন্ধ থাকা কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে। তারা তো লুকিয়ে করছে না। তারপর ডিএসই এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। ডিএসইকে এই অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। পুঁজিবাজারে যদি কোনো দুই নাম্বারি হয়ে থাকে, সেটা পুরো পৃথিবীতেই সবার আগে স্টক এক্সচেঞ্জ ধরে। বিএসইসিতো অনেক পরের বিষয়। প্রথমেই ধরবে স্টক এক্সচেঞ্জ। তাদের ওখানেইতো প্রতিদিন লেনদেন হয়। কোনো ধরনের অনিয়মের লেনদেন দেখলে বুঝতে পারা যায়। কিন্তু এখনও আমাদের পুঁজিবাজারে যে কোম্পানি বন্ধ এবং সবাই সেটা জানি, তারপরেও সেই কোম্পানির দর বাড়ে। কারা এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে এবং কারা বিক্রি করে- তা স্টক এক্সচেঞ্জ জানে। এখানে যে ম্যানিপুলেশন হচ্ছে এবং ওপেনলি হচ্ছে, লুকিয়ে কেউ করছে না। কিন্তু বাজার পড়ে গিয়ে কোনো কিছু হলেই রাস্তায় লোকজন নেমে সরকারকে দোষারোপ করে।
তিনি বলেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। পুঁজিবাজারের দায়িত্ব শুধু সরকার, অর্থ মন্ত্রণালয় ও বিএসইসির, আর স্টক এক্সচেঞ্জ শুধু বসে থাকবেন, তা না। তাদেরকে শক্তিশালী হতে হবে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদেরকে নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের এই মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা থেকে বেড়িয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। উপদেষ্টা বলেন, বিনিয়োগকারীদেরই জেনে-বুঝে বিনিয়োগ করতে হবে। লাভ-লোকসান আপনার।
দেশের পুঁজিবাজারকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে বেনিফিশিয়ারি অ্যাকাউন্ট (বিও) ডিজিটাল হওয়া উচিত উল্লেখ করে সালমান এফ রহমান বলেন, এটা ডিজিটাল হলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য যেমন সুবিধা হবে, তেমনি অনেক বিনিয়োগকারী বাসায় বসেই অ্যাকাউন্ট খুলে বিনিয়োগ করতে পারবেন। এখন অনেক ব্যাংক অ্যাকাউন্টও বাসায় বসেই ডিজিটালি করা যাচ্ছে।
বিএসইসির চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, গত তিন থেকে চার বছরের জমে থাকা আইপিওর আবেদনগুলো প্রায় শেষ। নতুন করে যেসব কোম্পানি আবেদন করবে তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে অনুমোদন দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে তিন মাস নয়, কাগজপত্র ঠিক থাকলে এক মাসের মধ্যে অনুমোদন দেয়া হবে। আমরা আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সময়ক্ষেপণ করব না।
শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজারে ভালো আইপিও আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছি। আইপিও অনুমোদন দেয়ার ক্ষেত্রে কোম্পানির বিগত বছরগুলোর ব্যবসা পর্যালোচনা করছি। বিশেষ করে কোম্পানিটির পরিশোধিত মূলধন কত এবং ৫ বছরের ট্যাক্স রেকর্ড বিশ্লেষণ করছি। মিউচুয়াল ফান্ড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গত কয়েক বছরে অনেক ফান্ড বিনিয়োগকারীদের কোনো রিটার্ন দিচ্ছে না, এটা ঠিক না। এ সময়ে অনেক মিউচুয়াল ফান্ড লভ্যাংশ দিলেও কিছু ফান্ড দিচ্ছে না। কারও চাপে নয়, বাজারের জন্যই পুঁজিবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডের প্রকৃত রূপ দিতে চাই।
পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (আইসিবি) সংস্কার করার কথা জানিয়ে শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, আইসিবিকে ফান্ড দিয়ে আরও শক্তিশালী করতে হবে। বাজারের নেগেটিভ ইক্যুইটি দূর করতে বিশেষ ফান্ড আসছে। সুদ কমিয়ে আনা হবে। বাইব্যাক (শেয়ার পুনঃক্রয়) পদ্ধতি চালু করা হবে। এক্ষেত্রে বাইব্যাক পলিসির কাজ করা হচ্ছে। বাইব্যাকের জন্য কোম্পানি আইনে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। বাজার গ্রিন ফিল্ড কোম্পানি আনা হবে। এক্ষেত্রে ই-কমার্স কোম্পানিগুলোকে অনুমতি দেয়া হবে। অর্থাৎ একটি গতিশীল পুঁজিবাজার গড়ে তোলা হবে।
বিএসইসি চেয়ারম্যান বলেন, পুঁজিবাজারে তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে বিদেশ থেকে একটি টিম আসছে। চলতি সপ্তাহে ডিএসই পরিদর্শন করবে। পুঁজিবাজারকে সত্যিকার অর্থেই ডিজিটাল করা হবে। এছাড়া সিডিবিএলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ন্যাশনাল আইডির মাধ্যমে কীভাবে অনলাইনে বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব খোলা যায় সে লক্ষে কাজ করা হচ্ছে।
এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, দেশের সব ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠানকে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় নয়। আমরা চাই, কর জিডিপি রেশিও বাড়াতে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে বিভিন্ন সুবিধা দিতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, রাজস্ব বোর্ড এবং বিএসইসিকে একযোগে কাজ করতে হবে। এজেন্ট ব্যাংকগুলো গ্রাম থেকে আমানত এনে শহরে বিনিয়োগ করছে। এটি মোটেই ভালো উদ্যোগ নয়।
ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, লভ্যাংশ দেয়া বাধ্যতামূলক করায় অনেক কোম্পানি ঋণ নিয়ে তা ডিভিডেন্ড দিচ্ছে। এটা সাময়িক ভালো হলেও দীর্ঘমেয়াদে সমস্যা হতে পারে। ক্ষুদ্র মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পকে বাজারে নিয়ে আসতে হবে। কোম্পানির আকার নয়, সম্ভাবনা দেখে এসব কোম্পানিকে আনতে হবে। বর্তমান কমিশন বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে এবং বিনিয়োগকারীরাও এসব উদ্যোগকে ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছে। এটি একটি ভালো দিক।
বিএমবিএর সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, পুঁজিবাজারের ভারসাম্য রক্ষায় চাহিদা ও জোগান জরুরি। এক্ষেত্রে পুঁজিবাজারে ভালো কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে হবে। ভালো ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাকে পুঁজিবাজারে আনতে কর প্রণোদনার পাশাপাশি পলিসি সাপোর্ট দেয়া জরুরি। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত-অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে কর ব্যবধান বাড়াতে হবে। তাহলে অনেকেই বাজারে আসবে। বিশেষ করে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দিনের পর দিন ব্যবসা করছে অথচ পুঁজিবাজারে আসছে না। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর কর্পোরেট কর হার ২০ শতাংশ করার দাবি জানাচ্ছি। এতে অনেক ভালো কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসতে আগ্রহী হবে। আর্থিক প্রতিবেদনে কারসাজি ঠেকাতে কেন্দ্রীয়ভাবে অডিট রিপোর্ট দেখভালের জন্য আলাদা ডাটাবেজ করা এবং ১০ শতাংশ আগাম করকে চূড়ান্ত কর হিসেবে গণনা করার দাবি করেন ছায়েদুর রহমান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন