হয়তো একেই বলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। মধ্যরাতের ভোটে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদকে টিকিয়ে রাখতে যে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেছিলেন, তাদেরই এক সদস্য চাকরী ছাড়ার পর নিহত হয়েছেন কথিত ক্রসফায়ারে। কেউবা রাস্তাঘাটে স্ত্রীর সামনেই বেদম মার খাচ্ছেন এমপিপুত্রের হাতে।
রোববার (২৫ অক্টোবর) রাতে রাজধানীতে ঘটে গেলো এমনই এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা।
কলাবাগান ক্রসিংয়ের কাছে নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ আহম্মেদ খানকে বেদম পেটান হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও তিনি।
নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনায় সন্ত্রাসী এমপি হাজী সেলিমের সন্ত্রাসী পুত্রকে সোমবার দুপুরের দিকে আটক করেছে র্যাব।
এছাড়া, হাজী সেলিম ও তার ছেলে ইরফান সেলিমের বাসভবনে অভিযান চালিয়ে গুলিভর্তি পিস্তল, ইয়াবা ও বিদেশি মদ উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে গাড়িচালক মীজানুর রহমানকে।
হাজী সেলিমকে চেনেন না, রাজধানীতে এমন মানুষ কম আছেন। পুরান ঢাকায় সন্ত্রাসী লালন-পালন, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ধ্বংস করে ঐতিহ্যবাহী ভবন দখল, জমি দখল থেকে শুরু করে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা এই এমপি ও তার দলবল করছে না। তবে- তার অপরাধ জগতের সব অপকর্ম ছাড়িয়ে যায়, ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর রাজধানীতে বামপন্থী সন্ত্রাসী বাপ্পাদিত্য বসুদের সঙ্গে মিলে লাঠি, লগি, বৈঠা নিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যার মতো নির্মম মানবতাবিরোধী অপরাধে।
আর সেই সন্ত্রাসী এমপিরই ছেলে ইরফান সেলিম, রোববার যার হাতে মার খেলেন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুরান ঢাকার স্থানীয় বেশ কয়েকজন জানিয়েছেন, এলাকায় এমন কোনো অপকর্ম নেই যা এই এমপিপুত্র করেন না। কিন্তু, পিতার দাপটে এলাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না। এমনকি র্যাব বা পুলিশের সদস্যদের সাথেও রয়েছে হাজী সেলিমের গভীর সখ্য। ফলে সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যেতো এই সন্ত্রাসী ছেলে।
এমপিপুত্র ও দেহরক্ষীর ১ বছর করে সাজা
এদিকে, মদ্যপান ও ওয়াকিটকি ব্যবহার করায় হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম এবং তার দেহরক্ষী মোহাম্মদ জাহিদকে এক বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
সোমবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা নাগাদ পুরান ঢাকার সোয়ারিঘাটে হাজী সেলিমের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ওই দুজনকে গ্রেপ্তারের পর এই দণ্ড দেওয়া হয়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালতের এই দণ্ডের পাশাপাশি দুজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও মাদক আইনে দুটি মামলা দায়ের করা হবে।
নয়তলা ওই ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ইরফান সেলিম থাকেন জানিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার জানান, ওই দুই ফ্লোর থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, এক রাউন্ড গুলি, একটি এয়ারগান, ৩৭টি ওয়াকিটকি, একটি হাতকড়া এবং বিদেশি মদ ও বিয়ার পাওয়া গেছে।
তিনি আরো জানান, আগ্নেয়াস্ত্রের কোনো লাইসেন্স নেই। আর ওয়াকিটকিগুলোও অবৈধ, কালো রঙের এসব ওয়াকিটকি শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যবহার করতে পারেন।
কী ঘটেছিলো সেই রাতে?
এমপিপুত্রের হাতে মার খাওয়ার পর বেআইনিভাবে পথরোধ করে সরকারি কর্মকর্তাকে মারধর, জখম ও প্রাণনাশের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ এনে ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট মো. ওয়াসিফ আহমেদ খান।
হাজী সেলিমের ছেলেসহ চারজনের নাম উল্লেখ করে মামলাটি করেন তিনি।
ধানমন্ডি থানার পরিদর্শক (অপারেশনস) রবিউল ইসলাম জানান, মামলার আসামিরা হলেন ইরফান সেলিম, এ বি সিদ্দিক দীপু, জাহিদ, মীজানুর রহমান ও অজ্ঞাতনামা আরও দু-তিনজন ব্যক্তি।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ রোববার রাত পৌনে ৮টার দিকে স্ত্রীকে নিয়ে মোটরসাইকেলে করে কলাবাগানের দিকে যাচ্ছিলেন। ল্যাবএইড হাসপাতালের সামনে সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো একটি কালো রঙের ল্যান্ড রোভার গাড়ি (ঢাকা মেট্রো-ঘ-১১-৫৭৩৬) পেছন থেকে তার মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয়।
ওয়াসিফ ও তার স্ত্রী ধাক্কা সামলে মোটরসাইকেল থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে ওই গাড়ি থেকে জাহিদ, দিপু এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও দুই-তিনজন ‘অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ’ করতে করতে নেমে আসে এবং ‘মারধর’ শুরু করে।
তারা লেফটেন্যান্ট ওয়াসিফ ও তার স্ত্রীকে ‘উঠিয়ে নেওয়ার এবং হত্যার’ হুমকি দেয় বলেও মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
ধানমণ্ডির ওসি ইকরাম আলী বলেন, গাড়িটি ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের। তবে ঘটনার সময় তিনি গাড়িতে ছিলেন না। গাড়িতে হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম ছিলেন।
এই দানবদের সৃষ্টি করেছে কারা:
নিয়তি বড়ই নির্মম! মধ্যরাতের নির্বাচনে হাজি সেলিমদের এমপি বানাতে পুলিশ ও সশস্ত্র বাহিনীর লোকেরাই সহযোগিতা করেছিলেন। তাদের সহযোগিতাতেই শত শত গাড়িতে ‘সংসদ সদস্য’ স্টিকার লাগিয়ে এখন দেশব্যাপী এমপি ও তার বাহিনীর লোকজন দাপটের সাথে ঘুরে বেড়ান।
এইতো মাত্র কয়েক মাস আগেই টেকনাফে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করা হয় অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদকে। এক সময় শেখ হাসিনার নিরাপত্তা রক্ষী হিসেবে অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন এই মেজর। অথচ তাকেই বেঘোরে প্রাণ হারাতে হয়েছিলো পুলিশের গুলিতে।
ভোট চুরিতে সরাসরি সহায়তাকারী পুলিশ যেখানে জনগণকেই পরোয়া করে না, সেখানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর তাদের কাছে এখন একদমই তুচ্ছাতি তুচ্ছ। মেজর সিনহা হত্যা মামলা এখন হিমঘরে।
সিনহা রাশেদ হত্যার রেশ কাটতে না কাটতেই খোদ রাজধানীতে দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন এমপিপুত্র। নৌ কর্মকর্তাকে মারধর করে দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছেন তিনি।
গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড ভাঙতে পুলিশের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আওয়ামী লীগের সহায়তা করেছিলো এই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাই। জনগণের মেরুদণ্ড ভাঙার পর এখন তাদের গড়া দানবরা তাদেরই দাঁত ভাঙছেন।
জনতাই এগিয়ে গিয়েছিলো সাহায্যে:
অথচ স্ত্রীর সামনে যখন এই নৌ কর্মকর্তাকে এমপিপুত্র পিটাচ্ছিলেন, তখন তিনি মারধর থেকে রক্ষার আকুতি জানিয়েছিলেন উপস্থিত সাধারণ জনতার কাছে। সাধারণ জনগণই তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যান।
ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, লে.ওয়াসিমের ঠোঁট দিয়ে রক্ত ঝরছে, তিনি ঘর্মাক্ত। বিচার চান এমন ভঙ্গিতে চিৎকার করতে করতে তিনি বলছেন, একজন নাগরিক তাঁর জীবন রক্ষা করেছে। তা নাহলে তাঁকে তারা (এমপিপুত্র ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী) মেরেই ফেলতো। তিনি প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তায় এসএসএফে দায়িত্ব পালনের কথাও জানান।
লে. ওয়াসিমের বলেন, নির্যাতনের সময় নিজের পরিচয় দিয়েও তিনি রক্ষা পাননি।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রক্তাক্ত লে.ওয়াসিম ও তার স্ত্রীকে ঘিরে রয়েছেন একদল সাধারণ মানুষ। কেউ সরব কেউ নীরব। তিনি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি চাইছেন।
জনগণ এগিয়ে না আসলে হয়তো আরো ভয়ঙ্কর পরিণতি বরণ করতে হতো তাকে।
ঘটনাস্থলে লোকজন জমে গেলে সাংসদের গাড়ি ফেলে মারধরকারীরা সরে যান। পরে পুলিশ এসে গাড়ি ও মোটরসাইকেলটি থানায় নিয়ে যায়।
কেউ কেউ নির্মম এই মারধরের ভিডিও ধারণ করেও রাখেন। ফলে এমপিপুত্রকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটকৌশল হয়তো কিছুটা কমে গেছে বলে অনেকে মনে করছেন।
বাংলাদেশে জনগণের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার, ভোটের অধিকার, কথা বলার অধিকার কেড়ে নিতে দিনের পর দিন সহায়ক শক্তি হিসেবে ন্যাক্কারজনক ভূমিকা রাখছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। তাদের গড়া দানবরাই এখন তাদের হত্যা করছে, রাস্তাঘাটে পিটিয়ে রক্তাক্ত করছে।
ইতিহাসের নির্মম পরিণতি তো এমনই!
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন