কুঁড়েঘর থেকে নতুন ভবনের মালিক হয়েও শান্তিতে নেই কক্সবাজারের খুরুশকুলে গড়ে ওঠা প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা। পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তা না থাকায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় রয়েছেন তারা। প্রতিনিয়ত বখাটে ও দুর্বৃত্তদের যন্ত্রণায় অতিষ্ট হওয়ার কথা জানিয়েছেন অনেকেই। এসব ব্যাপারে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের কাছে বিচার দিলেও কোনও প্রতিকার না পাওয়ায় হতাশায় তারা। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, এমন সমস্যা শোনার পর তারা ব্যবস্থা নিয়েছেন। এখন এই আশ্রয়ন প্রকল্পের বাসিন্দাদের নিরাপত্তায় অস্থায় পুলিশ ফাঁড়ি বসানোর কাজ চলছে।
কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে প্রধানমন্ত্রীর গড়ে দেওয়া এই আশ্রয়ণ প্রকল্পটি। এখানকার ঝিনুক ভবনের ৫০১ নং ফ্লাটের বাসিন্দা মো. সিরাজুল ইসলাম (৩০)। তিনি জানান, ‘কুঁড়েঘর ছেড়ে দামি ভবন পেয়ে আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি ভবনে কোনও শান্তি নেই। এক শ্রেণির দুর্বৃত্ত আমাদের ওপর নির্যাতন শুরু করেছে, যাতে আমরা ফ্ল্যাট ফেলে চলে যাই। গত ১৮ অক্টোবর দিনেদুপুরে আমি আশ্রয়ণ কেন্দ্রে ফেরার সময় পথের মধ্যে মারধর করে আমার দোকানের জন্য নিয়ে আসা মালামাল কেড়ে নেয়। সাত জন দুর্বৃত্তের একটি দল আমাকে ভবিষ্যতে জানে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে চলে যায়।
কক্সবাজারে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য শেখ হাসিনার বিশেষ আশ্রয়ন প্রকল্প
গত ১৭ অক্টোবর সকালে শহরের ৬ নং ঘাট দিয়ে নৌকাযোগে আশ্রয়ন প্রকল্পে ফেরার পথে মারধরের শিকার হন সাদ্দাম হোসেন নামের জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর আরেক সদস্য। সাদ্দাম জানান, তিনি নৌকাযোগে নদী পার হওয়ার সময় কিছু লোক ব্যাপক মারধর করেন। তারা ফ্ল্যাটে না যেতে হুমকি দিয়ে চলে যায়। এভাবে প্রতিদিন ঘটনা ঘটাচ্ছে স্থানীয় বখাটেরা। এসব ঘটনার কারণে আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে’র বাসিন্দারা।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের গন্ধরাজ ভবনের ২০১ নং ফ্ল্যাটে বাসিন্দা মরিয়ম। স্বামী ও দুই ছেলে নিয়ে থাকার জন্য প্রকল্পের একটি ফ্ল্যাট ভাগ্যে জুটেছে তার। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতে একদল বখাটে তাদের ভয়ভীতি ও নির্যাতন শুরু করে। ১৭ অক্টোবর বিকালে অসুস্থ এক ছেলেকে ডাক্তার দেখাতে শহরে যাচ্ছিলেন। স্বাভাবিক পথে যেতে বাধা দেওয়া হয়, তাই নৌকা নিয়ে বেক্রিমকোঘাট দিয়ে পার হচ্ছিলেন, কিন্তু নৌকাটি কুলে ভিড়তেই তা উল্টে দেয় স্থানীয় দুর্বৃত্তরা। কোলের সন্তানসহ পানিতে পড়ে সারা শরীর ভিজে যায় মরিয়মের। অসুস্থ সন্তানকে আর ডাক্তার দেখানো সম্ভব হয়নি।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের ফলক
শুধু মরিয়ম, সিরাজ ও সাদ্দাম নয়। তাদের মতো অনেকেই বলছেন, অট্টালিকার ফ্ল্যাটে থাকলেও সুখে নেই। প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসী ও দুর্বৃত্তদের ভয় তাড়া করছে তাদের। চলতে ফিরতে জান হারানোর আশঙ্কা। কিন্তু কারা এবং কী কারণে তাদের ওপর বারবার হামলা করছে সে বিষয়ে কোনও বাসিন্দা মুখ খুলছেন না। চোখে-মুখে অজানা ভয় তাড়া করছে তাদের।
জানতে চাইলে কক্সবাজার পৌরসভার সংরক্ষিত ওয়ার্ডের (১,২,৩) কাউন্সিলর কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র শাহেনা আকতার পাখি জানান, ‘এসব অভিযোগের ভিত্তিতে আমি খুরুশকুল আশ্রয়ণ কেন্দ্রের বাসিন্দাদের দেখতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করি। সেখানকার বাসিন্দাদের নানা অভিযোগ আমাকে বিচলিত করেছে। একারণে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬০০ মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।’
আশ্রয়ন প্রকল্পে হামলার ঘটনার ঘটনা শুনে নেমে এসেছেন উদ্বিগ্ন বাসিন্দারা। (সাম্প্রতিক ছবি)
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন জানান, ‘ওই আশ্রয়ণপ্রকল্প ও তার আশপাশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি করার জন্য ঢাকায় প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। তার আগ পর্যন্ত অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানোর চিন্তা চলছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পের আইন শৃঙ্খলাসহ সার্বিক বিষয়ে সদর ইউএনও দেখভাল করছেন।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুরাইয়া আকতার সুইটি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সম্প্রতি এখানে কিছু ঘটনা ঘটেছে। এগুলো আমাদের নজরে এসেছে এবং এগুলোর সমাধান হয়ে গেছে। এরপর থেকে আশ্রয়ন প্রকল্প এলাকায় পুলিশ টহল বাড়ানো হয়েছে। শিগগিরই এখানে একটা অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প হবে। এখন এ বিষয়ে প্রস্তুতি চলছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের ওপর কারা হামলা করছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যেহেতু বিষয়টার সমাধান হয়ে গেছে তাই কারও নাম বলা সমীচীন হবে না।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের করতে সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়। রানওয়েসহ অন্যান্য অবকাঠামো তৈরির জন্য অধিগ্রহণ করতে হয়েছে বিমানবন্দরের পশ্চিম পাশ লাগোয়া কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, নাজিরারটেক উপকূলের বিপুল পরিমাণ সরকারি খাসজমি। সেখানে এক যুগের বেশি সময় ধরে বসবাস করছিল চার হাজারের বেশি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ঘরবাড়ি হারিয়ে বিমানবন্দরের পাশে সমুদ্র উপকূলে আশ্রয় নিয়েছিলেন এসব গৃহহীন মানুষ। প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারে এসে জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, মাথা গোঁজার বিকল্প ঠাঁই না করে সরকারি খাসজমি থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা হবে না। এরপর অধিগ্রহণ করা সরকারি খাসজমিতে বসবাসকারী ৪ হাজার ৪০৯ পরিবারের অন্তত ২০ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তুকে পুনর্বাসনের জন্য খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের জন্য খুরুশকুলে অধিগ্রহণ করা হয় ২৫৩ দশমিক ৩৫০ একর জমি। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। এ পর্যন্ত পাঁচতলা বিশিষ্ট ১৯টি ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আরও একটি ভবনের নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে।
গত ২৩ জুলাই গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রথম ধাপে তৈরি ২০টি ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এসময় অন্তত ৬০০ জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারের হাতে ফ্ল্যাটের চাবি হস্তান্তর করা হয়। চাবিতে লেখা আছে, ‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’। এখন এসব ভবনে ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছে ৬০০টি পরিবার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন