রাষ্ট্রীয় অনাচার, ধর্ষণ, খুন, রাহাজানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন বাংলাদেশের আলেম সমাজ। শুক্রবার আলেম সমাজের গণসমাবেশে বক্তারা বলেন, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ হচ্ছে ইসলামী কৃষ্টি-কালচার। এই মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী হিন্দুত্ববাদের বিজাতীয় সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টার ফলেই দেশে ধর্ষণসহ রাষ্ট্রীয় অনাচার বেড়ে চলেছে। বিগত ১২ বছরে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদী হিন্দুত্ববাদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও রাষ্ট্রীয় অনাচার লাগামহীন বেড়ে যাওয়ার ফলেই দেশে ধর্ষণ আজ মহামারি রূপ নিয়েছে। স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে ধর্মীয় মূল্যবোধের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো সুপরিকল্পিতভাবে উঠিয়ে দেয়া হয়েছে গত ১২ বছরে। ফলে নীতি নৈতিকতাহীন একটি জাতি তৈরির সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে শেখ হাসিনার সরকার।
শুক্রবার (১৬ অক্টোবর) জু’মার নামাজ শেষে ৬ দফা দাবীতে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেইট থেকে ইসলামী দলগুলোর লংমার্চ কর্মসূচি শেষে গণসমাবেশে বক্তারা বলেন, ইসলাম ধর্মীয় মূল্যবোধের সংস্কৃতিতেই নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত রয়েছে। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্মীয় সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টার ফসল হচ্ছে আজকের ধর্ষণের মহামারি। বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে নারীদেরকে বিজ্ঞাপনের পণ্য হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। পণ্যের বিজ্ঞাপন হিসাবে নারীদের অর্ধনগ্ন উপস্থাপন অবিলম্বে বন্ধের দাবী জানিয়ে বক্তারা বলেন, অবিলম্বে রাষ্ট্রীয় অনাচার ও গুম-খুন বন্ধ না হলে দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ওলামায়ে কেরাম রাস্তায় নামতে বাধ্য হবেন।
উল্লেখ্য, দেশে চলমান নারী ধর্ষণ ও রাষ্ট্রীয় অনাচারের বিরুদ্ধে কথিত সুশীল সমাজ ও নারীবাদীরা যখন মুখ লুকিয়ে মৌনতা অবলম্বনে রয়েছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে নারীদের নিরাপত্তার দাবীতে আলেম সমাজ রাজপথে নেমে এসেছেন। সোচ্চার আওয়াজ তুলেছেন হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। দাবী তুলেছেন নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেইট থেকে লংমার্চ শুরু হয়ে বিজয়নগর মোড়ে গেলে পুলিশ বাধা দেয়। সেখানে রাস্তায় তারা গণসমাবেশ করেন। সমাবেশে সভাপতির বক্তৃতায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী বলেন, ধর্ষণ-নির্যাতন বন্ধে শুধু আইন করলেই হবে না। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। জেনা, ব্যভিচার, ধর্ষণের উৎস চিহ্নিত করে সেগুলো অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তিনি বলেন, দেশের মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করে বিজাতীয় সংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা নতুন নয়। দীর্ঘদিন থেকেই এই অপচেষ্টা অব্যাহত ছিল। কিন্তু বর্তমান শাসন আমলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকেও ধর্মীয় শিক্ষা উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
লং মার্চে উপস্থিত জনতার একাংশ
তিনি বলেন, দেশে একদিকে করোনাভাইরাসের আক্রমণ, অন্যদিকে মা-বোনদের ইজ্জত-আব্রু লুণ্ঠিত হচ্ছে। হায়েনার মতো নারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, হত্যা নির্যাতন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ধর্ষণের উৎস হচ্ছে আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী হিন্দুত্বের নগ্নতা। এই নগ্নতা ও বেহায়াপনা বন্ধ না হলে ধর্ষণ বন্ধ হবে না। পশ্চিমা সংস্কৃতির কারণে সমাজ থেকে লজ্জা-শরম উঠে যাচ্ছে। ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে অপসাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। দেশের মানুষের হাজারো বছরের ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে হবে। শিক্ষানীতি ও পাঠ্যসূচি ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষার আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের প্রচার সম্পাদক মাওলানা জয়নুল আবেদীন ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রচার সম্পাদক মাওলানা ফয়সল আহমদের পরিচালনায় সমাবেশে আরো বক্তৃতা করেন, ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের আমির ড. মোহাম্মদ ঈশা সাহেদী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহসভাপতি মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মাওলানা মজিবুর রহমান হামিদী, মুসলিম লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সহ-সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, মাওলানা ফজলুল করিম কাসেমী, খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, মাওলানা তোফাজ্জল হোসেন মিয়াজী, মাওলানা আজিজুল হক, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জালালুদ্দিন আহমদ, মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন, মাওলানা এনামুল হক মুসা, ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের মহাসচিব ড. মোস্তফা তারেকুল হাসান, খেলাফত আন্দোলনের সহকারী মহাসচিব মাওলানা ফিরোজ আশরাফী প্রমুখ।
ধর্ষণ ও জেনা-ব্যাভিচারের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি প্রকাশ্যে বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে আল্লামা মামুনুল হক বলেন, আমরা আজকে অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে রাজপথে আসতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের কথাগুলো পরিষ্কার। আমরা ধর্ষণ ও জেনা-ব্যভিচারের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি প্রকাশ্যে বাস্তবায়নের দাবি জানাই।
সরকারকে সতর্ক করে তিনি বলেন, প্রচার মাধ্যমে নারীকে অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করার হিন্দুত্ববাদী অপতৎপরতা বন্ধ করতে হবে। যারা নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে, ব্যবসার পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করছে তারা মাতৃজাতির কলঙ্ক। নারীকে বাণিজ্যিকভাবে পণ্যের বিজ্ঞাপন হিসাবে নয়, ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে মর্যাদা দিতে হবে।
সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে মামুনুল হক বলেন, আমরা একটা সময় পর্যন্ত দাবি জানাবো। সরকারের উদ্দেশ্যে বলবো, নারীকে এই অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করার প্রবণতা বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। যদি আমাদের শান্ত আন্দোলনের ভাষা বুঝতে সরকার ব্যর্থ হয়, তাহলে তৌহিদি জনতা এই অশ্লীলতার প্রচার কেন্দ্র গুলোকে নিজ হাতে ভেঙ্গে খান খান করে দেবে।
তিনি বলেন, ইসলামবিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদের দোসরেরা ধর্ষণ বন্ধ করতে চায় না। ওরা ধর্ষণবিরোধী বিভিন্ন সমাবেশের নামে রাজপথে প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অশ্লীল যৌন আচরণের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কিত করার পাঁয়তারা করছে।
তিনি বলেন, সরকার একদিকে সিনেমা হল খুলে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। অথচ ওয়াজ মাহফিলের অনুমতি দেয়া হয় না। গোটা দেশে জেনা-ব্যভিচার উসকে দেয়ার জন্যই সিনেমা হল উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। মাহফিল বন্ধ করে সিনেমা হল উন্মুক্ত করার কোনো পাঁয়তারা চালানো হলে তৌহিদি জনতা সিনেমা হল দখল করে সেখানে মাহফিল করবে।
ড. মোহাম্মদ ঈশা সাহেদী বলেন, সারাদেশে যখন জেনা-ব্যভিচারের উৎসব চলছিলো সরকার তখন নীরব ছিলো। কিন্তু সারাদেশে মানুষ ধর্ষণের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে তখন ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আইন করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে জেনা-ব্যভিচার সম্পর্কে কোনো কথা বলা হয়নি। যদিও কুরআনে জেনা-ব্যাভিচারের কঠিন শাস্তি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের আইনে জনগণ সন্তুষ্ট নয়। জেনা-ব্যভিচার, ধর্ষণ বন্ধে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন করতে হবে।
মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী বলেন, সমমনা দলসমূহের আজকের গণমিছিল প্রমাণ করে ধর্ষণ ও জেনা-ব্যভিচার প্রতিরোধে সমমনা ইসলামী দলসমূহের ৬ দফা দাবী সরকারকে মানতে হবে।
সমমনা দল ঘোষিত দাবী গুলো হচ্ছে- ১। জেনা, ব্যভিচার ও ধর্ষণ প্রতিরোধে জনসম্মুখে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ২. পর্নোগ্রাফির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৩. মাদকদ্রব্যের অবাধ প্রাপ্তি ও ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ৪. নারীর অশ্লীল উপস্থাপনা ও পণ্য হিসাবে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ৫. আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ এবং বিচার কাজকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ মুক্ত রাখতে হবে এবং ৬. নারীর মর্যাদা এবং অধিকার সংরক্ষণে কুরআন-হাদীসের শিক্ষাসমূহ জাতীয় শিক্ষা কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের মতো সারাদেশে ধর্ষণের মহামারি ছড়িয়ে পরেছে। ধর্ষণ বন্ধে শুধু মৃত্যুদণ্ডের আইন করলেই হবে না, তার সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। বিচার দ্রুত করতে হবে। বেহায়াপনা, পর্নোগ্রাফি, মাদকদ্রব্যের সহজলভ্যতা বন্ধ করতে হবে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামী আদর্শ বাস্তবায়ন করতে হবে।
মাওলানা মজিবুর রহমান হামিদী বলেন, ময়মনসিংহে নারীর যে অশ্লীল মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে অবিলম্বে তা সরিয়ে নিতে হবে। তা নাহলে ময়মনসিংহের অশ্লীল মূর্তি অপসারণে ময়মনসিংহ অভিমুখে লংমার্চ করা হবে।
শুক্রবার জু’মার নামাজ শেষে হাজারো মুসল্লি লংমার্চে যোগ দেন। নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবার শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে গোটা বায়তুল মোকাররম ও পল্টন এলাকা। হাজারো জনতার মুখরিত লংমার্চ থেকে সাম্রাজ্যবাদী ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দেয়া হয় তখন। লংমার্চ কর্মসূচি উপলক্ষে জনতার উপস্থিতিতে পল্টন, বায়তুল মোকাররম, বিজয়নগর, গুলিস্তানের রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এসব এলাকা ছিল জনতার দখলে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন