নভেল করোনাভাইরাসের অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ মহাপ্রতারণা ও তামাশায় পর্যবসিত হয়েছে। ব্যাংক ঋণ কি করে প্রণোদনা হয়, সে প্রশ্ন উঠেছে ঘোষণার পরপরই। আর এখন সেই ব্যাংক ঋণও না পেয়ে হা-হুঁতাশ শুরু করেছেন এক দশক ধরে সরকারের তল্পিবাহকের ভ’মিকায় থাকা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।
গার্মেন্টস সেক্টরের শাসকদলঘনিষ্ঠ কতিপয় নেতা কাম ব্যবসায়ী শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার নাম করে নামমাত্র সুদে ৫ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। ১৮টি মাসিক কিস্তিতে ফেরৎ দেওয়ার অঙ্গিকারে নেওয়া এসব টাকা ফেরতের জন্য এখন তারা ৫ বছর সময় চাইছেন। কৃষিখাতের ৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় ৬ মাসে দেওযা হয়েছে মাত্র ১ হাজার ১১৪ কোটি টাকা। আর শ্রমজীবী মানুষের নামে দলীয় কয়েক লাখ কর্মী সমর্থকের মোবাইল একাউন্টে এককালীন ২৪শ’ টাকা করে ভাগবাটোয়ারা হয়েছে। এর বাইরে কর্মহীন ও দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফনে পর্যুদস্ত সাধারণ মানুষ কথিত প্রণোদনা প্যাকেজ বা অন্য কোন অনুদান পায়নি চলমান মহামারির মহাদুর্যোগে। কাজ হারিয়ে বিদেশফেরৎ প্রবাসীদের কর্মসংস্থানে ঋণ সহায়তার জন্য রাখা ২ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে এখনও বিতরণ হয়নি এক কোটিও।
বহুল আলোচিত প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে ব্যাংকাররা বলছেন, ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্ক ও আস্থার ভিত্তিতে ব্যাংক ঋণ বিতরণ করা হয়। এটা ব্যাংক ব্যবসার অংশ। সরকারের ঘোষণা বা হুকুমে ব্যাংক ঋণ দেওয়া যায় না। প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় লাখ কোটি টাকার ব্যাংক ঋণ বিতরণ হলে সরকার সুদ বাবদ যে ভর্তুকি দেবে মূলতঃ সেটাই প্রণোদনা হিসেবে বিবেচিত হবে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। পুুরো ঋণ বিতরণ করা সম্ভব হলে সরকারের তহবিল থেকে সুদ বাবদ ভর্তুকিতে খরচ হবে ২ হাজার কোটি টাকা। সরকারের পক্ষ থেকে মহামারি-বিধ্বস্ত অর্থনীতির জন্য ২ হাজার কোটি টাকার সুদ ভর্তুকি ছাড়া আর কি করা হয়েছে সে প্রশ্নও গুঞ্জরিত হচ্ছে।
এদিকে সরকারের নির্দেশে যেনতেনভাবে কথিত প্রণোদনার ঋণ দিয়ে আরও লাখ কোটি টাকা ঝুঁকিতে ফেলার মত সামর্থ্য ব্যাংকের আছে কিনা সেটা সরকার বিবেচনা করেনি বলে ক্ষোভ ঝাড়ছেন অনেক ব্যাংকার। এরই মধ্যে তিন লাখ কোটি টাকার খেলাপী ঋণের বেশীরভাগই মন্দ ঋণে পরিনত হওয়ায় তা ফেরৎ আসা এক রকম অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। আবার সরকার ব্যাংকের ঘাড়ে ভর করে একের পর এক ঘোষণা দিচ্ছে যে ঋণের কিস্তি আদায়ে চাপ দেওয়া যাবে না। ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে খেলাপী না করার নির্দেশ ছিল। এখন তা ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হচ্ছে। ফলে যাদের সামর্থ্য আছে, তারাও ঋণের কিস্তি পরিশোধ বন্ধ করে দিয়েছে। এতে ব্যাংকগুলো মহাবিপাকে পড়েছে। জানুয়ারিতে ঋণ গ্রহীতারা একসঙ্গে ১০-১২ কিস্তি কিভাবে পরিশোধ করবে সে দুশ্চিন্তা ভর করেছে ব্যাংক কর্তাদের মাথায়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে, প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় এখনও পর্যন্ত ২০ শতাংশ ঋণও দিতে পারেনি ব্যাংক। এ নিয়ে গত সপ্তাহে ব্যাংকগুলোকে শোকজ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থমন্ত্রণালয় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়ে প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ বিতরণে অগ্রগতি জানতে চাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ফিরতি চিঠিতে যে চিত্র অর্থমন্ত্রণালয়কে দিয়েছে তা হতাশাজনক। অর্থমন্ত্রণালয়ে পাঠানো বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ব্যাংক-নির্ভর ৭২ হাজার কোটি টাকার ৮টি প্যাকেজের মধ্যে দু’টি প্যাকেজে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত এক টাকাও বিতরণ করা হয়নি। অন্য তিনটি প্যাকেজের মধ্যে কেবলমাত্র তৈরী পোশাক শিল্পের বেতন খাত ছাড়া অন্য দু’টি প্যাকেজেও বিতরণের পরিমান খুবই নগণ্য। ব্যবসায়ীরা বলছেন করোনা মহামারির ৬ মাসে আর্থিক ক্ষতি পোষাতে যে ঋণ এখনো পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে এবং তার সুদ বাবদ সরকার যে ভর্তুকি দেবে তার হিসাব কষে দেখা গেছে রাষ্ট্রীয় সহায়তার পরিমান সাকূল্যে ৪শ’ কোটি টাকার বেশি নয়। অথচ সরকারের সর্বোচ্চ চেয়ার থেকে লাখ কোটি টাকার গল্প শুনিয়ে রাজনৈতিক স্টান্টবাজি করা হচ্ছে। সরকারের এক নম্বর ব্যক্তি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের মাধ্যমে এমন প্রতারণামূলক প্যাকেজ ঘোষণায় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের অনেকেই বিস্মিত ও অসন্তুষ্ট হলেও রোষানলে পড়ার আশংকায় কেউ মুখ খুলতে চাইছেন না।
বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত রোগী প্রথম চিহ্নিত হয় মার্চ মাসের ৮ তারিখে। এর প্রায় এক মাস পর প্রথমে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে ও পরে গণভবণ থেকে ঘটা করে ভার্চুয়াল প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করে প্রথম ধাপে অর্থনৈতিক ঝুঁকি মোকাবিলায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । মোট পাঁচটি প্যাকেজের আওতায় এই প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। বেতার টিভিতে সরাসরি সম্প্রচারিত ওই প্যাকেজ ঘোষণার পর সরকারের বশংবদ কয়েকটি ট্রেড বড়ি থেকে অভিনন্দন জানাতেও দেখা যায়। চাটুকার মিডিয়ার টকশোতে প্রশংসায় ভাসানো হয়।
এর পর বিভিন্ন পর্যায়ে আরও ১৫টিসহ মোট ২০টি প্যাকেজের কথা জানাচ্ছে অর্থমন্ত্রণালয়। এতে প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমান ১ লাখ ৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। ৮টি প্যাকেজ সরাসরি ব্যাংক নির্ভর।
ঘোষিত ব্যাংক-নির্ভর ৮টি প্যাকেজের মধ্যে শিল্প ঋণের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের ২০ হাজার কোটি টাকা, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে পাঁচ হাজার কোটি টাকা রয়েছে। পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষ ও কৃষকের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন ফান্ড ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, প্রিশিপমেন্ট ঋণ পাঁচ হাজার কোটি টাকা, গরিব মানুষের নগদ সহায়তা ৭৬১ কোটি টাকা, অতিরিক্ত ৫০ লাখ পরিবারকে দশ টাকা কেজিতে চাল দেয়ার জন্য ৮৭৫ কোটি টাকা। এছাড়া করোনাভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্যখাতে বাজেটের অতিরিক্ত ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য, যে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির প্রকল্পটি গত প্রায় এক দশক ধরেই চালু আছে, সেটিকেও করোনাকালীন প্যাকেজ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর গরীব মানুষের মধ্যে বিতরণের ৭৬১ কোটি টাকা ৫০ লাখ লোকের মোবাইল একাউন্টে ২৪০০ টাকা করে পাঠানোর কথা ছিল। সেখানে সরকার দলীয় জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের দলীয় ও আত্মীয়-স্বজনের তালিকা পাঠানোর কারণে এ পর্যন্ত অর্ধেক টাকাও বিতরণ করা যায়নি। বিতরণকৃত অর্থের প্রায় পুরোটাই গেছে ‘আওয়ামী গরীব’দের মোবাইল একাউন্টে। এ নিয়ে ঢাকার গণমাধ্যমে কয়েকটি অনুসন্ধানী রিপোর্টের পর বাকিটা বিতরণ বন্ধ হয়ে যায়।
ঘটা করে প্যাকেজ ঘোষণার শুরুতেই প্রশ্ন্ন উঠে, প্রণোদনার অর্থের সংস্থান নিয়ে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তখনই বলেছেন, পুরো টাকাটাই আসবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে। সরকারকে বাড়তি তেমন কোনো টাকা ব্যয় করতে হবে না। শুধু ঋণের সুদ বাবদ দুই হাজার কোটি টাকা ভতুর্কি দিতে হবে।
এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে তা কেবল আপৎকালীন সময়ের জন্য। বিশেষ বিবেচনায় দেওয়া এ প্যাকেজে সরকারের ব্যয় তেমন নেই। কারণ পুরো টাকাটা আসবে ব্যাংকিং খাত থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, মোট পাঁচটি প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও সব প্যাকেজে সরকার সুদ-ভতুর্কি দিচ্ছে না। শুধু প্রথম দুটি প্যাকেজের ক্ষেত্রে ভতুর্কি দেওয়া হবে। প্রথম প্যাকেজে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের জন্য ৩০ হাজার কোটি ঋণ সুবিধা দেওয়া হবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। সুদের অর্ধেক সরকার ভর্তুকি দেবে। বাকি অর্ধেক দিতে হবে উদ্যোক্তাদের। দ্বিতীয় প্যাকেজে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা দেওয়ার কথা। এর সুদ হারও হবে ৯ শতাংশ। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার ৫ শতাংশ সুদ ভতুর্কি দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই টাকা বাজেট থেকে দেওয়ার জন্য ২ হাজার কোটি টাকার রাখার কথা সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে অর্থমন্ত্রণালয়। ভতুর্কি বাদে প্যাকেজের পুরো টাকাটাই ব্যাংক তাদের গ্রাহণকদের সাথে সম্পর্ক ও আস্থার ভিত্তিতে ঋণ হিসেবে দেবে। ফলে লাখ কোটি টাকার প্যাকেজ স্রেফ ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে ঢাকা চেম্বর অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ‘প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে সরকারি-বেসরকারি সব কটি ব্যাংকেই হতাশাজনক চিত্র। আমরা খুবই হতাশ। ব্যাংকগুলোর কোন সমস্যা থাকলে সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে বলা উচিৎ। তিনি বলেন, করোনার কারণে ব্যবসায়ীরা এমনিতেই সমস্যায় আছে। ব্যাংকগুলো যদি ঠিকভাবে ঋণ বিতরণ না করে তা হলে আরও সমস্যার সৃষ্টি হবে। আমরা চলতি মূলধন পাচ্ছি না। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনে সমস্যা আরও বাড়বে’।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন