এবছর করোনার শুরুতে ইতালি থেকে কয়েকশ’ প্রবাসী বাংলাদেশী স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দেশে গেছিলেন। বিমানে উঠার সময় তারা জানতেন না, যে কত হেনস্থা এবং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য অপেক্ষা করছে তাদের জন্যে। কোয়ারেন্টাইনের নামে তাদেরকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তো রাখা হয়েছিলই, সেই সঙ্গে জুটেছিল বাংলাদেশের পরাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন এবং প্রশাসনের অন্যান্য ব্যক্তিদের গালমন্দ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন সমস্থ প্রবাসী বাংলাদেশীদের নবাবজাদা বলে উপহাস করেছিলেন। অথচ, এই প্রবাসী বাংলাদেশীরাই বিদেশে প্রাণান্তকর পরিশ্রমের বিনিময়ে অর্জিত অর্থ দেশে পঠিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রেখেছেন।
বৈশ্বিক মহামারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হলেও প্রবাসে অক্লান্ত পরিশ্রমী বাংলাদেশীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ ক্রমেই বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেও (জুলাই-আগস্ট) উল্লেখযোগ্যহারে বেড়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। প্রবাসে নিরলস পরিশ্রম, আত্মীয়-পরিজন ছাড়া একা বসবাস তদুপরি ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে পদে পদে হয়রানি ও নানা অবহেলার শিকার এই প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে যোগান দিচ্ছেন সিংহভাগ বৈদেশিক মুদ্রা।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের আগস্ট মাসে ১৪৮ কোটি ২৮ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই অংক গত বছরের আগস্ট মাসের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়নও (রিজার্ভ) বেড়েছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহের এমন প্রবৃদ্ধিকে ‘অভূতপূর্ব’ও ‘অবিশ্বাস্য ঘটনা’ হিসেবে অভিহিত করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, রেমিট্যান্স আনতে ২% হারে নগদ সহায়তায় প্রবাসীরা উৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে তাঁরা বেশি রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছেন।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের মতে, করোনার কারণে হুন্ডি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বৈধ পথে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। ফলে এর গতি অবিশ্বাস্যভাবে বেড়েছে।
কেউ বলেন, করোনায় অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে দেশে থাকা স্বজনদের রক্ষা করতেও প্রবাসীরা অতিরিক্ত অর্থ পাঠাচ্ছেন। তবে কেউবা এমনও বলছেন যে, ২% প্রণোদনার টাকা নয়ছয় করতেই হয়তো রেমিট্যান্স বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছে।
তবে যে যা-ই বলুক, এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা কোটি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ বা রেমিট্যান্স। মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে এই রেমিট্যান্সের অবদান ১২ শতাংশের মতো।
কিন্তু, দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখা এসব প্রবাসীদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করে শেখ হাসিনার সরকার?
‘নবাবজাদা’ নাকি হিরো?
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স অন্যতম প্রধান খাত হলেও প্রবাসীরা সবসময় অবহেলিত। তাদের প্রতি বিভিন্ন সময় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ঘৃণা প্রকাশ করেছে সরকার।
এমনকি, প্রতারণার শিকার হয়ে কর্মীরা যখন বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর সহযোগিতা চান, তখনও তাদের সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ ব্যবহার করা হয়। প্রতারণার শিকার হয়ে যখন তারা বাংলাদেশে ফেরেন তখন অনেকেরই ঠাঁই হয় কারাগারে। এমনকি বিদেশী কাজের জন্য পাড়ি জমানোর চেষ্টাকালে পদে পদে হয়রানি ও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে হয়। অনেকেই নিজের ভিটেমাটি বিক্রি করে নি:স্ব হয়ে পথে বসেন তখন।
সম্প্রতি ভিয়েতনামে গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়ে ফেরা ৮১ জন অভিবাসী শ্রমিকের সাথে এমনই নির্দয় আচরণ করেছে শেখ হাসিনার অনুগত আদালত ও লাঠিয়াল পুলিশ বাহিনী।
নিজেদের ব্যর্থতা ও দুর্নীতি আড়াল করতে ভিয়েতনাম ফেরত কর্মীদের ‘দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা এবং শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলার’ অপবাদ দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
অথচ, চলতি বছরের শুরুর দিকে জনশক্তি এজেন্টরা তাদেরকে ৫০০ থেকে ৬০০ মার্কিন ডলার বেতনে কর্মসংস্থানের কথা বলে ভিয়েতনামে পাঠায়। আর তাদের চাকরি নিয়ে বাইরে যাওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল সরকারি।
এখানে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কারণ, তারাই শ্রমিকদের বিদেশে কাজ করতে যাওয়ার আগে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এবং অফিসিয়াল ‘ছাড়পত্র’দেয়। বিএমইটির দায়িত্ব হলো-শ্রমিকদের ‘ভুয়া চাকরি’ নিয়ে বিদেশে যাওয়া রোধ করা। একশ’র বেশি শ্রমিককে ভিয়েতনামে চাকরি নিয়ে যাওয়ার সময় বিএমইটি কর্তৃপক্ষ তাদের সবার জন্য সরকারি ছাড়পত্র দিয়েছে। বিএমইটি যে চাকরির জন্য ছাড়পত্র দিয়েছে, তার জন্য চাকরিপ্রার্থীদের প্রত্যেকে এজেন্টদের চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা করে দিয়েছিল।
ইতালি ফেরত বাংলাদেশীদের সাথেও যে অন্যায় করেছিলো আওয়ামী লীগ সরকার, তাতো সবারই জানা।
গত ১৪ মার্চ ইতালি থেকে ১৪২ জন বাংলাদেশে ফেরেন। তাদেরকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যাওয়া হয় আশকোনা হজ ক্যাম্পে। কিন্তু চরম অব্যবস্থাপনা দেখে সেখানে থাকতে রাজি হননি তারা। প্রতিবাদের মুখে তাদেরকে বাড়িতে যেতে দেয়া হয়।
#ইতালি ফেরতরা হজ ক্যাম্পে না থাকতে চাওয়ায় পরের দিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, দেশে ফিরে সবাই ‘নবাবজাদা’ হয়ে যান। ফাইভ স্টার হোটেল না হলে থাকতে চান না।
এমন কটূক্তিতেও থেমে থাকেননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পরবর্তীতে কোনো কোনো প্রবাসীকে ‘কুলাঙ্গার’ বলেও গাল দেন আওয়ামী লীগ সরকারের এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী। অথচ তাদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স দিয়েই ফুলেফেঁপে বড় হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রবাসীদের গালমন্দ করলেও অর্থমন্ত্রী অবশ্য তাদেরকে হিরো বলেছেন।
যাদের রক্তে-ঘামে চাঙ্গা অর্থনীতি:
করোনার প্রভাবে বিদেশের মাটিতে প্রবাসীদের অনেকেই কাজ হারিয়েছেন। তা সত্ত্বেও পরিবার ও দেশের প্রতি ভালোবাসা থেকে অমানবিক পরিশ্রম আর দৈনিক অতিরিক্ত সময় কাজ করে দেশে টাকা পাঠান তারা।
২০১৯ সালের তুলনায় চলতি আগস্টে ৩৬ শতাংশ বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এই বাড়তি রেমিট্যান্স আসছে টানা তিন মাস ধরে। জুলাই-আগস্ট সময়কালে বার্ষিক ৫০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে রেমিট্যান্স এসেছে চার দশমিক ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
#লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক আব্দুল হান্নান বলেন, করোনা মহামারিতে আমরা সবাই কম বেশি চাকুরী হারিয়েছি। আর্থিক সঙ্কটে নেই এমন মানুষ কম আছে। তবে দেশে থাকা পরিবারকে বুঝতে দেয়নি কেউ কখনো। তার প্রমাণ প্রবাসীদের দেশে টাকা পাঠানোর রেকর্ড। তবে কষ্ট হয় যখন দেখি নানা সময়ে প্রবাসীদের অসম্মান করা হয়। বিশেষ করে ছুটিতে দেশে ফেরার সময় বিমানবন্দরে হয়রানি। এ নিয়ে প্রবাসে আমরা যারা থাকি তাদের নানা অভিযোগ রয়েছে। বেশি কষ্ট হয় যখন দেখি উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা প্রবাসীদের নিয়ে অপমানজনক কথা বলেন।
ইতালি প্রবাসী আইরীন পারভীন খান বলেন, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে আমরা দেশে টাকা পাঠাই। প্রবাসে কেউ মারা গেলে অনেক সময় চাঁদা তুলে মরদেহ দেশে পাঠাতে হয়। এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও আমরা নিজের কথা চিন্তা করি না। দেশে থাকা আত্মীয়-স্বজন ও দেশের কথাই চিন্তা করি।
করোনা মহামারী শুরুর পর ইতালিতে থাকা কিছু বাংলাদেশী দেশে ফিরেছেন। মানুষগুলো হয়তো বোকামি করেছে। তাদের যাওয়াই উচিৎ হয়নি সে সময়। কিন্তু, বাংলাদেশে নামার পর তাদের সাথে যে আচরণ করা হয়েছিলো তা মেনে নেয়া কঠিন। এমনকি তাদেরকে নিয়ে কটূক্তিও করেছিলেন এক মন্ত্রী।
তিনি বলেন, একটি গল্প পড়েছিলাম ছোট বেলায়, ব্যাঙের গায়ে যখন ঢিল ছোঁড়া হয় তখন পাড়ে থাকা ছেলে-মেয়েরা বুঝে না ব্যাঙের কষ্টটা কী! আমাদের প্রবাসীর অবস্থাও অনেকটা তাই।
জীবন-জীবিকার জন্য বিদেশে পাড়ি দিতে প্রতি বছর অনেক বাংলাদেশী মৃত্যুমুখে পতিত হন। প্রতারণার শিকার হয়ে মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়েও জীবন দিতে হয়েছে অনেককে। সর্বশেষ লিবিয়াতে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন।
বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৭৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ কাজ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। বৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো কর্মীদের খতিয়ান এটা। মৃত্যুকে বাজি রেখে সমুদ্রপথে যাওয়াদের হিসেব কেউ-ই জানে না। তাদের অনেকেই হারিয়ে গেছেন উত্তাল সমুদ্রে।
এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক বছরে শুধু মালয়েশিয়াতে ৭৮৪ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন। গত দশ বছরে বিদেশ থেকে মোট ২৬ হাজার ২৫৮ জনের লাশ ফিরেছে। ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে ১০০৮, কুয়েত থেকে ২০১, সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ২২৮, বাহরাইন থেকে ৮৭, ওমান থেকে ২৭৬, জর্ডান থেকে ২৬, কাতার থেকে ১১০, লেবানন থেকে ৪০ সহ মোট তিন হাজার ৫৭ জনের লাশ দেশে ফিরেছে।
এমনই কোটি কোটি প্রবাসীর রক্তে-ঘামে চাঙ্গা রয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন