নেত্রকোণা সদর হাসপাতালের অফিস সহায়ক আবদুল গনির আজ (শনিবার) ৫৯ বৎসর পূর্ণ হয়েছে। দুপুর দুইটার পরে তাকে বাসা থেকে ডেকে আনা হল। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের অফিসে ঢুকে তার চক্ষু ছানাবড়া। বড় একটি ব্যানারে লেখা, ‘আবদুল গনি সাহেবের অবসর উপলক্ষে বিদায় সংবর্ধনা’।
বিদায় সংবর্ধনা শুরু হল। তাকে নিয়ে নানা স্মৃতিচারণ হল। বাকি জীবন যেন তিনি ইবাদত বন্দেগী করতে পারেন, এই দোয়া চেয়ে চোখের জলে তিনি বিদায় চাইলেন । শেষে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের বক্তৃতার পালা। দীর্ঘ ৩৩ বছর তিনি দেশের সেবা করেছেন, এজন্য তাকে ধন্যবাদ জানান হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো।
বিদায়ী সংবর্ধনায় হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো বলেন, সরকারি চাকরি একজন কর্মচারীকে দেয় সামাজিক মর্যাদা, চাকরি জীবনে এবং চাকরি-উত্তর অবসর জীবনে দেয় অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। সরকারি কর্মচারীর ওপর অর্পিত দায়িত্ব হল তার ওপর অর্পিত আমানত। প্রত্যেক ব্যক্তিই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেককে তার দায়িত্বের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। যদি কেউ তার কর্মে ফাঁকি দেন, অবহেলা করেন, অন্যকে হেয় করেন, হয়রানি করেন, ইনটেনশনালী ন্যায়বিচার করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি আমানতের খেয়ানত করেন। এ ধরণের কাজ হারাম কাজ। হারাম খেয়ে ইবাদাত করলে ইবাদাত কবুল হয় না।’
এরপরই ঘটে নজিরবিহীন ঘটনা।
তিনি তার বক্তৃতার মধ্যেই বললেন, ‘আমি এখন এমন একটি কাজ করব, যে কাজ করতে আমি কোনোদিন কাউকে দেখিনি, আপনারাও হয়ত কোনোদিন দেখেননি।’
সবার চোখ তখন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়কের দিকে।
তখন তিনি একটি খাম খুলেন। সেখান থেকে বের হল একটি সাদা কাগজ। তার নিজ হাতে ড্রাফট করা একটি অফিসিয়াল চিঠি।
যে দিবসটি তার শেষ কর্মদিবস, সে দিবসেই স্বপ্রণোদিত হয়ে তাকে অবসর আদেশ, পিআরএল এবং লাম্পগ্র্যাান্ট মঞ্জুরের আদেশ দেন তিনি। তার এ মঞ্জুর আদেশটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। নেত্রকোণাবাসীর প্রশংসায় ভাসছেন আলোচিত সৎ ও মেধাবী কর্মকর্তা ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো।
আবেগে আপ্লুত গনি মিয়া যুগান্তরকে বলেন, আমি আমার ৩৩ বছর চাকরি জীবনে কোনো গাফিলতি করিনি। আর আমাদের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক স্যার (ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো) খুব ভালো মানুষ। তবে আমার কাগজপত্র দেখে যাচাই-বাছাই করে তিনি আমাকে পেনশনের টাকা এভাবে মঞ্জুর করবেন তা কল্পনাও করিনি। পেনশনের টাকার জন্য বছরের পর বছর ঘুরতে হয় এটাই দেখেছি। আমি স্যারের জন্য দোয়া করি, উনার মঙ্গল কামনা করছি।
জেলা সুজনের সভাপতি শ্যামলেন্দু পাল যুগান্তরকে বলেন, এটা একটা অকল্পনীয় ঘটনা। আমরা জানি পেনশনের কাগজের জন্য মাসের পর মাস ধর্না দিতে হয়। কিন্তু এরকম ঘটনা শুনি না। আর বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো খুবই সৎ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। এরকম কর্মকর্তা দেশের সব জায়গায় থাকলে মানুষ হয়রানির শিকার হতো না।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. জয়নাল আবেদীন টিটো যুগান্তরকে বলেন, দশ বছর আগে আমার মা সরকারি চাকরি (শিক্ষকতা) থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বহু ঘোরাঘুরি করেও পেনশনের টাকা না পেয়ে, শেষে অডিটরকে ৩৬ হাজার টাকা উৎকোচ দিয়ে তিনি তার পেনশনের টাকা তুলতে পেরেছিলেন। তখন আমি সংকল্প করি, আমি যেদিন পেনশন মঞ্জুরকারী কর্মকর্তা হব, সেদিন পেনশন প্রার্থী ব্যক্তির সব কাগজপত্র সঠিক থাকলে একদিনের মধ্যে পেনশন মঞ্জুর করব।
তিনি বলেন, এখন আমি আমার আওতাধীন তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পেনশন মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ। মানুষের উপকার করার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। চাকরি জীবনের শেষ দিনটিতে একজন অবসরপ্রার্থী বিনা কষ্টে অবসরাদেশ পেয়ে যতটুকু শান্তি পেয়েছেন, আমার দীর্ঘদিনের সংকল্প পূর্ণ হওয়ায় (আমার) আনন্দ এর চেয়ে কম নয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন