যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের প্রাইমারি নির্বাচনে বাংলাদেশি প্রার্থীরা জয়ের মুখ দেখেনি। পরাজয়ের পেছনে কেউ কেউ প্রার্থীদের অযোগ্যতাকে কারণ হিসেবে দেখছেন। স্বদেশিদের বিভক্তি, আবার অনেকে দায়ী করেছেন আঞ্চলিকতাকে। অন্যতম এই তিন কারণেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীরা ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারি নির্বাচনের জয়ের মুখ দেখেননি।
নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদে প্রার্থীদের হতাশাজনক পরাজয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে এখন আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। অনেকে ফেসবুকে শুরু করেছেন তুমূল কাদাঁ ছোঁড়াছুড়ি।
গত ৪ আগস্ট ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশি অধ্যুষিত হেমট্রামিক ও ডেট্রয়েট এলাকায় পৃথক দুটি পদে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দু’জন মার্কিন নাগরিক। মিশিগান রাজ্যের হাউস অব রিপ্রেজেনটিভ পদে ড্রিস্ট্রিক ৪ থেকে নির্বাচনে লড়েন হেমট্রামিক সিটির সাবেক কাউন্সিলম্যান সাহাব আহমেদ। অপরদিকে রাজ্যের ওয়েন কাউন্টির ডিস্ট্রিক ৩ থেকে কমিশনার পদে একই সিটির বর্তমান কাউন্সিলম্যান মোহাম্মদ হাসান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
জানা গেছে, রিপ্রেজেনটিভ পদে ১১ জন প্রার্থীর মধ্যে ইয়েমেনি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক আব্রাহিম আয়ায় বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তার প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ৪ হাজার ১৮০টি। বাংলাদেশি একমাত্র প্রার্থী সাহাব আহমেদ পেয়েছেন ৭০১ ভোট। ৯৩ ভাগ ভোট গণনা হয়েছে। ডাকযোগের ভোট গণনা বাকি রয়েছে। বাকি ৭ ভাগ ভোট বাংলাদেশি প্রার্থী সাহাব আহমেদের বাক্সে যোগ হলেও তার জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
এদিকে ওয়েইন কাউন্টি কমিশনার পদে দুই প্রার্থী লড়েছেন। এ পদে ১০ হাজার ৭৬১ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন মার্থা জি স্কাট। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মো. হাসান ৩ হাজার ৪৮১ ভোট পেয়ে বিশাল ভোটের ব্যবধানে হেরে গেছেন।
ম্যাকম্ব কাউন্টির কাউন্টি ডেলিগেট পদে জয়ী হয়েছেন বাংলাদেশি খাজা শাহাব আহমদ। হেমট্রামিক সিটির ৫ নম্বর প্রিসিস্কট ডেলিগেট পদে আর কোনো প্রার্থী না থাকায় বিনাপ্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হয়েছেন মিনহাজ চৌধুরী রাসেল। নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত তার গণসংযোগ সোশ্যাল মিডিয়াসহ স্থানীয় পত্রপত্রিকায় ঢালাওভাবে প্রচার করেন।
এদিকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদে প্রার্থীদের হতাশাজনক ফলাফল সম্পর্কে হেম্যাট্রামিক ও ডেট্রয়েট সিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই জাগো নিউজকে বলেছেন, ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’। নিজেদের কারণে বাংলাদেশি প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। মিশিগানে বিভিন্ন বাংলাদেশি রাজনৈতিক দলসহ বেশিরভাগ আঞ্চলিক সংগঠনে তৈরি হয়েছে বিভাজনের রাজনীতি।
স্বদেশি সংগঠনগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ছাপ পড়েছে এ নির্বাচনে। এক গ্রুপের নেতাকর্মীরা স্বদেশি প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করলে পাল্টাগ্রুপ নেতাকর্মীরা তলে তলে কাজ করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর হয়ে। যদিও সুধি সমাবেশ ডেকে স্বদেশি সংগঠনগুলোর নেতারা নিজ দেশের প্রার্থীদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ সমর্থন দেন।
তবে শেষ পর্যন্ত অনেকেই অনড় থাকতে পারেননি। এছাড়া একজন প্রার্থী নিজের জয়ের জন্য স্বদেশির বিপরীত প্রার্থীর সঙ্গে গোপন আঁতাত করার অভিযোগ উঠেছে। অনেকের বলছেন, বিশ্বাসঘাতকতা ও দুর্বল প্রার্থীর কারণে এমন পরাজয় হয়েছে।
হেমট্রামিক সিটির শিপলু ও মিজান বলেন, সাহাব আহমেদ কাউন্সিলম্যান থাকাকালীন মসজিদে উচ্চস্বরে আজানের অনুমতি আদায় করেন ও বাংলাদেশ এভিনিউ স্থাপন করা ছিল তার বিশেষ অর্জন। তিনি ছাড়া উদাহরণ দেয়ার মতো অন্যকারও দৃশ্যমান অর্জন নেই। কিন্তু বাংলাদেশি বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীদের কামড়াকামড়ি থাকায় নির্বাচনে আমাদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে।
কেউ কেউ ফেসবুক টাইমলাইনে মন্তব্য করেছেন, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দেশীয় রাজনীতি পরিহার করে এক জাতীয় একটি সংগঠন দাঁড় করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমেরিকার মূলধারার রাজনীনিতে এই দেশে জন্ম নেয়া অথবা বড় হওয়া নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত-মেধাবীদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
মিশিগান বিএনপি সেক্রেটারি সেলিম আহমেদ বলেন, ‘কমিউনিটির মানুষ নির্বাচন নিয়ে এতটা সক্রিয় ছিলেন না। কেউই স্বদেশি ভোটারদের জাগিয়ে তুলতে পারেননি। একজন প্রার্থী ৮ বছর পর নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিতে পুনরায় সক্রিয় হয়েছেন। নির্বাচনে তার সমন্বয় কম ছিল। আরেক প্রার্থী কমিউনিটির মানুষের ঠাসে ছিলেন। তিনি পরাজিত হলেও সন্তোষজনক ভোট পেয়েছেন’।
মিশিগান থেকে প্রকাশিত বাংলা সংবাদ পত্রিকার সম্পাদক ইকবাল ফেরদৌস বলেন, ‘নির্বাচনে আঞ্চলিকতা কাজ করেছে। এখানে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর চেয়ে বাংলাদেশি ভোটার কম। এছাড়া নিজেদের মধ্যে বিভক্তি। এজন্য স্বদেশি প্রার্থীরা কুলিয়ে উঠতে পারেননি’।
প্রবাসী এ সংবাদিক আরও বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশিরা নিজেরাই যেখানে ঐক্যবদ্ধ নই, সেখানে আমাদের জন্য ভোট দিতে অন্যরা ঐক্যবদ্ধ হবে। এটা আশা করা কঠিন। আমেরিকাতে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ডাক্তার, ইঞ্জিয়ার ও শিক্ষকতা পেশায় বহুজন রয়েছেন। কিন্তু মূলধারার রাজনীতিসহ প্রশাসনিক দিক থেকে আমরা এখনও পেছনে। এই প্রজন্মকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হলে সবকিছু ঝেড়ে এখনই আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে’।
পরাজিত প্রার্থী সাহাব আহমেদ তার প্রতিক্রিয়ায় জাগো নিউজকে জানান, পরাজিত মানে লোজার নয়, এখান থেকে লার্নিং নিতে হবে। স্বদেশিরা আমাকে ঠিকই ভোট দিয়েছেন। ইয়েমেনি, পোলিশসহ অন্যসব গোষ্ঠী মিলে মিশিগান কমিউনিটি। এখানে বাংলাদেশি কমিউনিটি বলে আলাদা করা ঠিক না। এখানকার আলো-বাতাসে আমরা বেড়ে উঠছি।
তিনি জানান, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কিছু রেখে যেতে হলে এটি আমাদের বুঝতে হবে। রাজনীতি থেকে দূরে ছিলাম আমার ওপর আনীত এই অভিযোগ ঠিক না। এই জায়গাকে ঘিরেই আমার সবকিছু। এছাড়া নির্বাচনে বিজয়ী আব্রাহাম আয়াসের মধ্যে দারুল লিডারশিপরয়েছে। আমি নিজে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছি। সাহাব আহমেদ তার কর্মী-সমর্থক ও ভোটারদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
পরাজিত আরেক প্রার্থী মো. হাসানের প্রতিক্রিয়া জানতে, বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার তার মুঠোফোনে কল করা হয়। রিং হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে সাংবাদিক পরিচয়ে তার মোবাইলে নম্বরে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়ে একদিন অপেক্ষা করেও কোনো সাড়া মেলেনি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন