পুলিশের গুলিতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ৭ দিনের রিমান্ডে থাকা কক্সবাজারের টেকনাফ থানার প্রত্যাহার হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। এই ভিডিওতে তিনি বলেছেন, চলতি বছরের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে টেকনাফকে মাদকমুক্ত করতে টেকনাফের প্রতিটি পাড়া–মহল্লার ইয়াবা কারবারিদের গ্রেপ্তার করা হবে। যাদের পাওয়া যাবে না, তাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, যানবাহন সমূলে উৎপাটন করা হবে। তাদের বাড়িতে গায়েবি হামলা হবে। কোনো কোনো বাড়ি ও গাড়িতে গায়েবি অগ্নিসংযোগও হতে পারে।
ওসির এই ভীতিকর ভিডিও বার্তা নিয়ে সেসময় অনেকে প্রশ্ন তুলে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা এভাবে গায়েবি হামলা ও অগ্নিসংযোগের হুমকি দিতে পারেন কি না।
ভিডি ্ওclick here
মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার আসামি হওয়ার পর বুধবার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তার বাড়ি চট্টগ্রামে। কক্সবাজারের আগে তিনি চট্টগ্রামের কর্মরত ছিলেন। ওই সময় জায়গা দখলসহ নানা অভিযোগ ওঠায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ মডেল থানায় ওসি হিসেবে যোগ দেন ২০১৮ সালে। এই দুই বছরে দেড় শতাধিক ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ঘটেছে এ থানা এলাকায়। প্রদীপ কুমার দাশ প্রায় ২৫ বছরের চাকরিজীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন চট্টগ্রাম অঞ্চলে। তিনি উপপরিদর্শক পদে ১৯৯৫ সালে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। প্রদীপ কুমার দাশ ২০১৯ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম) পান। পদক পাওয়ার জন্য তিনি পুলিশ সদর দপ্তরে ছয়টি কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের কথা উল্লেখ করেন। সব কটি ঘটনাতেই আসামি নিহত হন। এর আগে একাধিকবার রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম) পেয়েছেন তিনি।
প্রদীপ কুমার দাশ বিপিএম পাওয়ার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে যে ছয়টি ঘটনার উল্লেখ করেছেন, তার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় দুর্ধর্ষ অ্যাকশন সিনেমার। অ্যাকশন সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ডাকাত, সন্ত্রাসী, ইয়াবা কারবারি, মাদক, অস্ত্র, গোলাগুলি—সবই আছে এগুলোয়। তার সম্পর্কে পুলিশ সদর দপ্তরের বাছাই কমিটির মন্তব্য ছিল, নিরস্ত্র পুলিশ পরিদর্শক প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে বহুল আলোচিত ইয়াবার কেন্দ্রবিন্দু টেকনাফ থানা এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ অস্ত্রশস্ত্রসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের অস্ত্র, গুলিসহ গ্রেপ্তার ও বিপুল পরিমাণ ইয়াবা উদ্ধার করেন।
আলোচিত এই ওসি যে কৃতিত্বপূর্ণ অভিযানগুলোর কথা বলেছেন, সেগুলো ঘটে ২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে। অভিযানের প্রথমটি হয় ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর। প্রদীপ কুমারের ভাষ্য ছিল, টেকনাফ থানার সাবরাং ইউপির কাটাবনিয়া সাকিনে ঝাউবাগানে অভিযানে গেলে অস্ত্রধারী মাদক ব্যবসায়ীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোড়ে। এতে উত্তর জালিয়াপাড়া এলাকার হাসান আলী (৩৫) ও নাজিরপাড়া এলাকার মো. হোসেন প্রকাশ কামাল (২৮) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।
দ্বিতীয়টি ২৪ অক্টোবর। ঘটনাস্থল ছিল মহেশখালিয়া পাড়ার হ্যাচারিজোন এলাকায় জঙ্গল। ইয়াবা কারবারি মফিজ আলমকে পুলিশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় অস্ত্রসহ আটক করে। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এরপরের অভিযান একই বছরের ১৮ নভেম্বর। এর বর্ণনা দিতে গিয়ে ওসি প্রদীপ লেখেন, দক্ষিণ লেঙ্গুর বিলের ফরিদ আলমকে নিয়ে তার সহযোগী ভুলু মাঝির বাড়িতে উপস্থিত হলে অস্ত্রধারী ইয়াবা ব্যবসায়ীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। সন্ত্রাসীদের গুলিতে ইয়াবা ব্যবসায়ী মো. ফরিদ আলম গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
আরেকটি ঘটনায় ওসি প্রদীপ লেখেন, ২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর ‘ইয়াবা ব্যবসায়ী’ হাবিব উল্লাহ ওরফে হাবিবকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আটক করে পুলিশ। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। হাবিবের মৃত্যুর পর কক্সবাজার আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সারোয়ার কাবেরী ফেসবুকে একটি ভিডিও দেন। ওই ভিডিওতে হাবিবের স্ত্রীকে বলতে শোনা যায়, বাসা থেকে তার স্বামীকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বিচার চান। বুধবারও নাজনীন তার ফেসবুকে ওসি প্রদীপের অবৈধভাবে উপার্জিত সম্পদের ব্যাপারে তদন্ত দাবি করেন।
গত ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। তদন্তের স্বার্থে গত রোববার টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলীসহ সবাইকে প্রত্যাহার করা হয়। আর হত্যা মামলা হওয়ার পর বুধবার ওসি প্রদীপকে প্রত্যাহার করা হয়।
এদিকে হত্যা মামলা দায়েরের আগেই ওসি প্রদীপ স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে গত ৪ আগস্ট ছুটির আবেদন করেন। কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন তার ছুটির আবেদন গ্রহণ করেন বলে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাননি এসপি। মেডিকেল ছুটি নিয়েই ওসি প্রদীপ কক্সবাজার ছেড়েছেন। তাকেসহ মামলার আসামি নয় পুলিশ সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে কি না, জেলা পুলিশ নিশ্চিত করতে পারেনি।
বুধবার দুপুরেই মেজর (অব.) সিনহা হত্যার বিচার চেয়ে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন বড় বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। মামলাটির শুনানিতে সন্তুষ্ট হয়ে তা ‘ট্রিট ফর এফআইআর’ হিসেবে আমলে নিতে টেকনাফ থানাকে আদেশ দেন আদালতের বিচারক তামান্না ফারাহ। একইভাবে মামলাটি র্যাব-১৫ কক্সবাজার ক্যাম্পের অধিনায়ককে তদন্তের দায়িত্ব দিয়ে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে মামলা অগ্রগতির প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর রাত সাড়ে ১০টার দিকে টেকনাফ থানায় মামলাটি (নম্বর সিআর : ৯৪/২০২০ইং/টেকনাফ) তালিকাভুক্ত করা হয়। দণ্ডবিধির ৩০২, ২০১ ও ৩৪ জামিন অযোগ্য ধারায় মামলাটি তালিকাভুক্ত করা হয়।
প্রদীপ কুমার দাশ বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম মহানগরীর দামপাড়ায় পুলিশ লাইন হাসপাতালে যান। সেখান থেকে তাকে নিজেদের হেফাজতে নেন পুলিশ সদস্যরা। এরপর কড়া পাহাড়া দিয়ে প্রদীপকে নিয়ে পুলিশ চট্টগ্রামে থেকে বিকাল ৫টার দিকে কক্সবাজারের বিচারিক হাকিম আদালত প্রাঙ্গণে পৌঁছায়। তার জামিন নাকচ করে ৭ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন আদালত। এছাড়া বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলী এবং এস আই নন্দলাল রক্ষিতকেও ৭দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে। বাকি চারজন আসামীকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আর অভিযুক্তদের মধ্যে দুইজন আত্মসমর্পণ করেননি বলে বাদী পক্ষের আইনজীবী মোহম্মদ মোস্তফা জানিয়েছেন। এর আগে ৭ আসামিকে ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন করে র্যাব।
পূর্বপশ্চিমবিডি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন