চিকিৎসকদের জন্য হোটেল বাতিলের সিদ্ধান্ত কোনও বৈজ্ঞানিক অর্ডার হয়নি, একেবারেই না বুঝে চিকিৎসকদের ওপর এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত খুবই অমানবিক, অপমানজনক এবং অবমাননাকর বলে মন্তব্য করেছেন কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে কাজ করা চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, এই সিদ্ধান্তগুলো আমলাতান্ত্রিক না হয় বিজ্ঞানভিত্তিক হওয়া উচিত। কোভিড রোগীদের চিকিৎসা কী মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা করছেন নাকি চিকিৎসকরা করছেন সে প্রশ্নও তুলছেন চিকিৎসকরা। একইসঙ্গে চিকিৎসকরা এও বলছেন, সঙ্গ-নিরোধ (কোয়ারেন্টিন) আমাদের ছুটি নয়, এটা হাসপাতালে কাজের একটি অংশ। কোনওভাবেই তারা এসময়ে আমাদের বাড়িতে পাঠাতে পারেন না।
প্রসঙ্গত, করোনা প্রাদুর্ভাবের পর গত ১২ এপ্রিল রাজধানীর ছয় হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের স্বাস্থ্য সেবাদানকারী চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকার জন্য ১৯টি হোটেল নির্ধারণ করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু গত ২৯ জুলাই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আব্দুল মান্নান স্বাক্ষরিত জারি করা পরিপত্র অনুযায়ী করোনা রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের আবাসিক হোটেলের বিল পরিশোধ না করার সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে চিকিৎসকদের জন্য বরাদ্দ হোটেলের সুবিধাও বাতিল করে তারা।
পরিপত্র অনুযায়ী রাজধানী ঢাকার মধ্যে দায়িত্ব পালনকারী একজন চিকিৎসক দৈনিক দুই হাজার টাকা এবং ঢাকার বাইরে এক ১৮০০ টাকা, একজন নার্স ঢাকার মধ্যে এক হাজার ২০০ ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে এক হাজার টাকা এবং একজন স্বাস্থ্যকর্মী ঢাকার মধ্যে ৮০০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৬৫০ টাকা ভাতা পাবেন।
কিন্তু চিকিৎসকরা বলছেন, তারা কেউ এই টাকা চাননি, বরং পরিবারের সুরক্ষাটাই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে আগের নিয়ম অনুযায়ী সাত দিন ডিউটি করার পর ১৪ দিন আইসোলেটেড থাকার নিয়ম ছিল। কিন্তু এখনকার নিয়মে ১৫ দিন একটানা ডিউটি করার কথা বলা হয়েছে, এটা রীতিমতো আত্মহত্যার শামিল ,বলছেন তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক চিকিৎসক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, চিকিৎসকরা যখন কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে ডিউটি করেন তখন তারা হাইলি এক্সপোজড থাকেন। আর যেদিন শেষ ডিউটি করবেন কোনও চিকিৎসক তার পরবর্তী ১৪ দিন কোয়ারেন্টিন থাকতেই হবে কারণ চিকিৎসকরা সাধারণ মানুষের চেয়ে তিনগুণ বেশি রিস্কে থাকেন। আর তাই ডিউটি করার পর চিকিৎসকদের জন্য কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল যেন পরিবারের কেউ তার থেকে সংক্রমিত না হন।
সবার পরিবারেই ছোট সন্তান, বৃদ্ধ বাবা-মা এমনকি অনেকের পরিবারের দাদা-দাদি, নানা-নানিরাও থাকেন। এই মানুষগুলো এমনিতেই অনেক ঝুঁকিপূর্ণ মন্তব্য করে চিকিৎসকরা বলেন, দেশের কোভিড হাসপাতালগুলোতে সার্ভিস দিচ্ছেন বেশিরভাগ তরুণ চিকিৎসকরা। তাদের বেশিরভাগই আর্থিকভাবে এতটা সচ্ছল নয় যে পরিবার থেকে আলাদা থাকবেন, অথবা বড় ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন। তারা কোথায় যাবেন?
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কোভিড ইউনিটে দায়িত্বরত এক চিকিৎসক বলেন, শুরুর দিকে, চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা ভাড়া বাড়িতে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন, পরে তার সমাধান হয়েছে সে ভাড়া বাড়িতে থেকে ডিউটি না করার কারণে। কিন্তু এখন যদি চিকিৎসকরা আবার সেই ভাড়া বাড়িতে থেকে হাসপাতালে ডিউটি করেন, তাহলে সে সমস্যা আবার তৈরি হবে। চিকিৎসকরা কখনওই লেকশোর বা রিজেন্সির মতো হোটেলে থাকার দাবি করেনি, তারা কেবল প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তা হিসেবে তাদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী থাকার ব্যবস্থা চেয়েছিলেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা হয়েছে সঙ্গ-নিরোধ ছুটির জন্য বাসায় যাবেন। চিকিৎসকরা সঙ্গ-নিরোধের জন্য পরিবারের কাছে যাবেন। কোভিড হাসপাতালে ডিউটি করে আমরা পরিবারের মানুষের কাছে যাবো সঙ্গ-নিরোধ করতে, এটা হয় কখনও? কার সঙ্গে আলোচনা করে মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। তাহলে তো ডিউটিতে থাকার সময়ও আমরা বাসায় থাকতে পারি, সেটা তে অসুবিধা কী? আর সঙ্গ-নিরোধ কোডিভ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসকের ছুটি নয়, তার ডিউটির অংশ। কেউ যদি কোভিড রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত না থাকছেন তাহলে তাকে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে যেতে হচ্ছে না। এটা আমাদের ডিউটির একটা অংশ, যাতে করে আমি কাউকে সংক্রমিত না করি।
চিকিৎসকদের দাবি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া দুই হাজার টাকা কেউ চায়নি, বরং এটা আমাদের অপমান এবং অবমাননা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। টাকা নিয়ে পরিবারের সদস্যদের রিস্কে কেউ ফেলবে না। কেউ তাদের কাছে টাকা চায়নি, সুরক্ষা চেয়েছে। এই সিদ্ধান্ত মোটেই যুক্তিসংগত নয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে আবাসিক হোটেলে না থেকেও অনেক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা হোটেলের বিল তুলে নিয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা পুরো চিকিৎসক সমাজকে হেয় করা মন্তব্য করে সাধারণ চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসকরা কীভাবে বিল তুলবেন, বিলের দায়িত্ব তো চিকিৎসকদের নয়। চিকিৎসকদের সে ক্ষমতাই নেই, এর পুরোটা ‘ডিল’ করে মন্ত্রণালয়।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, কোভিড শুরুর প্রথম দিকে নিম্নমানের সুরক্ষা সামগ্রী দিয়ে চিকিৎসকদের মেরে শান্তি হয়নি, এখন প্রশাসনের মানুষ তাদের পরিবারসহ মারতে চাচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত কোনওভাবেই বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্ত হয়নি, এটা অবৈজ্ঞানিক এবং অত্যন্ত অবমাননাকর সিদ্ধান্ত।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন