আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে দেশ পরিচালনা করছে। আর তৃতীয় মেয়াদে এসে সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদের চেয়ে আমলাদের প্রভাব অনেক বেশি লক্ষণীয়। বিশেষ করে করোনা সঙ্কটের সময় দেশে আমলাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আর এই বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পর দলে সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি কে এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
যেকোন একটি রাজনৈতিক সরকারে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকই হন দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি। কিন্তু তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারে দলের সাধারণ সম্পাদক যে দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি নন এটা নিশ্চিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এবং সাধারণ মানুষ। কারণ সরকার যে সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে সেই সিদ্ধান্তের অনেককিছুই অজানা দলের সাধারণ সম্পাদকের। এমনকি অনেক সিদ্ধান্ত তিনি অনেক পরে জানছেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। আওয়ামী লীগের যে মন্ত্রিসভা আছে, সেই মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরাও দলের নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে নেই বলেই মনে করা হয়। বরং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁদেরকে সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্ব দেন এবং সেই দায়িত্বগুলো যেন তাঁরা সুস্পষ্টভাবে পালন করেন সেটাই প্রত্যাশা করেন। এভাবেই সরকার চলছে। আর প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছে, চিন্তাচেতনা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। আওয়ামী লীগ মোট চার মেয়াদে ক্ষমতায় আছে, প্রথম মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের মুখ্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ড. মো. সামাদ। তিনিও অত্যন্ত ক্ষমতাবান ছিলেন। কিন্তু সেই সময়ে মহিউদ্দিন খান আলমগীর, শাহ এমএস কিবরিয়া, মোহাম্মদ নাসিম, তোফায়েল আহমেদ, আমির হোসেন আমুর মতো ডাকসাইটের নেতাদের ভিড়ে মুখ্য সচিব হিসেবে মো. সামাদ শুধু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভেতরেই ক্ষমতাবান ছিলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা সরকার পরিচালনায় তাঁর ভূমিকা খুব একটা ছিলনা।
২০০৮ সালে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসলে একাধিকবার মুখ্য সচিব পরিবর্তন হয়। প্রথমে মুখ্য সচিব হন আবদুল করিম, তিনি খুব একটা কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান ক্ষমতাবান থাকলেও সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাঁর ভূমিকা খুব একটা ছিলনা। আবুল কালাম আজাদ মুখ্য সচিব হয়ে প্রশাসনে নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছায় প্রশাসনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রদবদল হতো বলে অনেকেই মনে করেন। তবে সরকার পরিচালনার সিদ্ধান্তে তাঁর ভূমিকা খুব বেশি ছিলনা। যদিও বিদ্যুত ক্ষেত্রসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর প্রভাব বলয় ছিল, কিন্তু নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁর ভূমিকা খুব একটা চোখে পড়েনি। ড. কামাল নাসের চৌধুরীও মুখ্য সচিব হিসেবে শুধুমাত্র সাচিবিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন, একই অবস্থা ছিল ড. নজিবুর রহমানের। কামাল নাসের চৌধুরী এবং নজিবুর রহমান যখন মুখ্য সচিবের দায়িত্ব পালন করেন সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদকে এসডিজি বিষয়ক এবং সেই সময়েও তিনি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতেন বলে পরিলক্ষিত হয়।
কিন্তু জানুয়ারি মাসে ড. আহমদ কায়কাউস দায়িত্ব গ্রহণের পর চিত্র পাল্টে গেছে। বিশেষ করে করোনা সংক্রমণের পর থেকে তিনি তাঁর মেধা-দক্ষতা দিয়ে যেমন প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিশ্বস্ত হয়েছেন, তেমনি তাঁর যোগ্যতার বলে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের উপরে গতিবিধি-নজরদারি করতে গিয়ে সেসব মন্ত্রণালয়ের উপরেও তাঁর একটি কর্তৃত্ব সৃষ্টি হয়েছে। এই করোনা সঙ্কটে যখন সরকারের আমলাদের উপর নির্ভরতা বেড়েছে তখন ড. আহমদ কায়কাউস হয়ে উঠেছেন সরকারের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কাজের সমন্বয় সাধন করে তিনি আলোচিত হয়েছেন, প্রশংসিত হয়েছেন। বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যখন সীমাহীন ব্যর্থতা এবং সমন্বয়হীনতা করছিল তখন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই মুখ্য সচিব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের উপরে নজরদারি শুরু করেন, দুঃস্থ মানুষদের মাঝে ত্রান বিতরণ কার্যক্রমেও প্রধানমন্ত্রী দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য মুখ্য সচিবকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এখন বন্যা মোকাবেলার ক্ষেত্রেও মুখ্য সচিব সার্বিকভাবে কাজ করছেন।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেই যেহেতু সবগুলো কাজের সমন্বয় করা হচ্ছে, সেহেতু প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী মুখ্য সচিব এই দায়িত্বগুলো পালন করছেন এবং প্রধানমন্ত্রীর যে নির্দেশনা-পরিকল্পনা, তা বাস্তবায়নের জন্যেই মুখ্য সচিব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। আর মেধাবী অফিসার হওয়ার কারণে অনেক নতুন নতুন আইডিয়া তিনি সরকারে সঞ্চালনের চেষ্টা করছেন, মেধাবী অফিসারদের সামনে আনতে চাইছেন। আর যেহেতু দেশ এখন বহুমাত্রিক সঙ্কটের মুখে, সেজন্য অর্থ মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়গুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করে কাজ করতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হয়ে এই সমন্বয়ের কাজ করছেন মুখ্য সচিব। আর এই কারণেই তিনি এখন আলোচনার পাদপ্রদীপে। তবে মুখ্য সচিব হিসেবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাই পালন করে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনেক কর্মকর্তা। তাঁরা বলেন, তিনি নিষ্ঠাবান অফিসার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাগুলো সুচারুভাবে বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছেন। একারণেই তাঁকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হচ্ছে। এর মানে এই নয় যে তিনি ক্ষমতাবান। তবে করোনা সঙ্কটের সময় ড. আহমদ কায়কাউস আলোচনায় যেমন এসেছেন, তেমনি তাঁর বিচক্ষণতা তাঁর মেধা প্রশংসিত হচ্ছে সর্বত্র। অনেক সিদ্ধান্তের জন্যেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এখন মুখ্য সচিবের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর এই জন্যেই হয়তো অনেকেই মনে করছেন যে, সরকারে তিনিই এখন দ্বিতীয় ক্ষমতাবান ব্যক্তি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন