নানা কৌশলে প্রতারণা করে মানুষকে সর্বস্বান্ত করাই ছিল রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদের কাজ। রিজেন্ট কেভিএস লিমিটেডের নাম করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে টেন্ডার বাগিয়ে নিতেন তিনি। পরে সেগুলো চড়া দামে অন্যত্রে বিক্রি করে দিতেন। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কাজ বাগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম ব্যবহার করাই ছিল সাহেদের অন্যতম হাতিয়ার। এভাবে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে বালু ও পাথর সাপ্লাই দেওয়ার কাজও পেয়েছিলেন তিনি। এই কাজ করতে গিয়ে অন্তত ২০ জন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীকে পথে বসিয়ে দিয়েছেন সাহেদ। তাদের কয়েকজন দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, অন্তত ১০০ কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন সাহেদ। কেউ পাওনা টাকা চাইলে তাকে মেরে ফেলার হুমকিও দিতেন তিনি।
করোনাভাইরাস পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়াসহ নানা প্রতারণার অভিযোগে পলাতক সাহেদকে গ্রেপ্তার করতে র্যাবসহ একাধিক সংস্থা কাজ করছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তিনি কিছুতেই দেশ ছাড়তে পারবেন না। তাকে ধরতে একাধিক টিম কাজ করছে। এর মধ্যে গতকাল শনিবার রাতে রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে সাহেদের পাসপোর্ট, কম্পিউটার হার্ডডিস্ক, ল্যাপটপ জব্দ করে র্যাব। পৃষ্ঠা ২ কলাম ৪ >
ভুক্তভোগী কয়েকজন ব্যবসায়ী দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, সাহেদ যেকোনো মানুষের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ে এমন ভাব দেখাতেন যেন তিনি ‘ভাজা মাছ উল্টিয়ে খেতে জানেন না’। তার চেয়ে ভালো মানুষ পৃথিবীতে নেই। অথচ সাহেদ ভয়ংকর প্রতারক। এমনও ব্যবসায়ী আছেন পাঁচ বছর ধরে টাকা পান। টাকা দাবি করলেই দিতেন মেরে ফেলার হুমকি। তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক থাকে দুর্ধর্ষ কিছু অপরাধী। সরকারের হাইকমান্ড, র্যাব ও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দোহাই দিয়ে এসব অপকর্ম চালান সাহেদ।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা দেশ রূপান্তরকে জানান, করোনার নকল সনদ দেওয়ায় ও রোগীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে গত ৬ জুলাই উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতাল সিলগালা করা হয়। টনক নড়ার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরও হাসপাতালটির সার্বিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। র্যাবের তদন্তেও বেরিয়ে আসছে সাহেদের উত্থানের বিস্ময়কর কাহিনী। সাহেদ তার প্রতারণার নিপুণ কৌশল কাজে লাগিয়ে করোনা মহামারীতে নিজেকে স্বাস্থ্য খাতের অন্যতম ‘মাফিয়া’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ভুক্তভোগীরা তাদের প্রতারিত হওয়ার অসংখ্য অভিযোগ র্যাব সদর দপ্তরে জানাচ্ছেন। এ-সংক্রান্ত ফোনের পর ফোন রিসিভ করতে হচ্ছে র্যাবকে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, গত দশ বছর ধরেই সাহেদ নানা অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন। তার ভয়ে কেউ কথা বলতে পারতেন না। সাহস করে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে র্যাব বা পুলিশ দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করতেন। ক্ষমতাসীন দলের দাপট দেখিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের ব্যবহার করতেন সাহেদ। সচিবালয়েও তার অবাধ চলাফেরা ছিল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে ভাগিয়ে নিতেন। পরে ওইসব টেন্ডার চড়া দামে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতেন। টেন্ডারের মাধ্যমে ইট, বালি ও পাথর সাপ্লাই দিতেন সরকারি বিভিন্ন অফিসে, আবার তদবির করে অন্যদের টেন্ডারের ইট, বালি ও পাথর সাপ্লাই দিতেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, সাহেদ ওইসব প্রতিষ্ঠানে ভালো মানের মাল দেওয়ার কথা বলে নিম্নমানের মাল দিয়েছেন কয়েক বছর। এসব কাজ পাইয়ে দিতে দুটি সংস্থার কয়েকজন বড় কর্মকর্তা সুপারিশ করতেন বলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো তথ্য পেয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সংস্থার এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে জানান, ‘সাহেদ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ভালো মালামাল এনে সেগুলো অন্য জায়গায় বিক্রি করে নিম্নমানের মাল ক্রয় করতেন অন্য জায়গা থেকে। তার প্রতিটি কাজই ছিল ধোঁকাবাজি। তাকে যারা সহায়তা করেছেন তাদের নাম আমরা জানতে পেরেছি। বিষয়টি সরকারের হাইকমান্ডকে অবহিত করা হয়েছে। সাহেদ রাষ্ট্রের নামি-দামি লোকদের দোহাই দিয়ে টেন্ডার ভাগিয়ে নিতেন। এমন কোনো কাজ নেই যে সাহেদ করেননি। সাহেদ হিটলারকেও হার মানিয়েছেন।’
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাসেম গতকাল দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, ‘সাহেদ কিছুতেই দেশত্যাগ করতে পারবে না। তাকে ধরতে র্যাবের একাধিক টিম কাজ করছে। সাহেদ ইন্টারন্যাশনাল বাটপার। মানুষের ক্ষতি ছাড়া তার কোনো কাজ ছিল না।’ তিনি বলেন, ‘অনেক ব্যবসায়ীর টাকা মেরে দিয়েছে সাহেদ। সে বিভিন্ন মান্যগণ্য ব্যক্তির সঙ্গে ছবি তুলে সেগুলো দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের হুমকি ধমকি দিত বলে অভিযোগ আছে।’
পাথর ব্যবসায়ী জুলফিকার আলী দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সাহেদের হয়ে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে বালি ও পাথর সাপ্লাই দিয়েছেন। এজন্য তার কাছে ৪০ লাখ টাকা পাওনা আছে। টাকা দাবি করলে পুলিশ ও র্যাব দিয়ে হুমকি দিত। তার সঙ্গে র্যাব-পুলিশের ভালো সম্পর্ক ছিল। উত্তরায় রিজেন্ট অফিসে একবার গিয়েছিলাম টাকা আনতে। কিন্তু সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সাহেদ আমাকে একটি রুমে আটকে রাখে। মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলেÑ আর যদি টাকার জন্য আসিস তাহলে জীবন এখানেই শেষ করে দিব।’ তিনি বলেন, ‘সে প্রায়ই বলত মন্ত্রী-মিনিস্টার, আইজিপি, র্যাবের ডিজিসহ সবাই আমার লোক। আমার অনেক শক্তি। তোদের মতো লোক আমার কিছুই করতে পারবি না। তুই কোনো টাকা পাবি না।’ সাহেদ তার প্রতিষ্ঠানের নামে টেন্ডার ভাগিয়ে অন্য জায়গায় চড়া দামে বিক্রি করত বলেও জানান পাথর ব্যবসায়ী জুলফিকার। দেশ রূপান্তরকে একই কথা বলেছেন আরেক পাথর ব্যবসায়ী জাহিদুল আলম। তিনি বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের নাম ড্রিম রোড স্টোন। এক দালালের মাধ্যমে সাহেদের সঙ্গে তার পরিচয় বছর তিনেক আগে। জাহিদুল বলেন, ‘তখন সে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলত। এমন ভাব নিত এই পৃথিবীতে সে ছাড়া আর ভালো মানুষ নেই। দুই বছর আগে আমাকে জানায়, আমি টেন্ডারের কাজ পেয়েছি। অনেক পাথর লাগবে। পরে তার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হই। সরল বিশ্বাসে ৩২ লাখ টাকার মাল দেই। কিন্তু একটি টাকাও দেয়নি। টাকা চাইলেই প্রাণনাশের হুমকি দিত। তার প্রতিটি কাজই ছিল প্রতারণা। আমাদের মতো অন্তত বিশ জনের ১০০ কোটি টাকা মেরে দিয়েছে প্রতারক সাহেদ।’
মুখ খুলছেন আইটি প্রধান : রিজেন্টের আইটি শাখার প্রধান তারেক শিবলী রিমান্ডের প্রথম দিন গতকাল শনিবার ‘চমকপ্রদ তথ্য’ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদে তারেক জানিয়েছেন, করোনা রোগীদের মোটা অঙ্কের বিল দিতে বাধ্য করা হতো। তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেদের নির্দেশেই আমরা এসব করেছি। গত তিন মাসে প্রায় ৩ কোটি টাকা আয় করেছি। সাহেদ ভুয়া পরিচয় দিয়ে নানাভাবে প্রতারণা করেছে মানুষের সঙ্গে। সে একটা এমএলএম কোম্পানি খুলে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল, যার জন্য জেলও খেটেছে। জাল করেই করোনা সার্টিফিকেট দেওয়া হতো। এটি করেই অনেক টাকা আয় হয়েছে। প্রভাব খাটিয়ে এসব অপকর্ম করত সে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বড় বড় কর্মকর্তার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক। বিএনপি সরকারের আমলে রাজাকার মীর কাসেম আলী ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। ২০১১ সালে ধানম-ির ১৫ নম্বর রোডে এমএলএম কোম্পানি বিডিএস ক্লিক ওয়ান নামে বাটপারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে সাহেদ। এ রকম কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে তার। মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক বিমানবন্দর শাখা থেকে ৩ কোটি টাকা লোন নিয়েছিল সাহেদ। কিন্তু ওই টাকা পরিশোধ করেনি।’ জিজ্ঞাসাবাদে তারেক শিবলী আরও জানিয়েছেন, উত্তরার ৪, ৭ ও ১৩ নম্বর সেক্টরে ভুয়া শিপিং প্রতিষ্ঠান খুলে অনেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সাহেদ।
‘সমাজসেবক’ হিসেবে আবির্ভূত হন সাহেদ : নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, করোনা শুরু হওয়ার আগে সাহেদের সঙ্গে অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সামনাসামনি দেখা হয়নি। করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির শুরুর দিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বেসরকারি হাসপাতালের প্রতিনিধি হিসেবে সাহেদকে প্রথম চোখে পড়ে তাদের। আগে অবশ্য তাকে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আলোচক হিসেবে দেখেছিলেন। ওই সময় বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনা রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। তখন রীতিমতো ‘সমাজসেবক’ হিসেবে আবির্ভূত হন সাহেদ। তিনি দেশ ও জাতির স্বার্থে তার মালিকানাধীন উত্তরা ও মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতাল দুটিতে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে রাজি হন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন