রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বৈধ লাইন্সেস ছাড়া চিকিৎসা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসার জন্য সরকার নির্ধারিত হাসপাতাল ও ল্যাব রয়েছে। অথচ প্রতি অর্থবছর লাইসেন্স নবায়ন করা বাধ্যতামূলক। ২০১৮ সালে নবায়ন ফি বাড়ানোর পর থেকে এই কার্যক্রম অনেকটা মন্থর হয়ে পড়ে। এ জন্য হাসপাতালগুলোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মনিটরিং না থাকা ও গাফিলতিকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সারাদেশে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি। এর মাত্র ৫ হাজারের বৈধ লাইসেন্স রয়েছে। বাকি সব অবৈধ লাইসেন্সে চিকিৎসা কার্যক্রম চালাচ্ছে। এ বিষয়টি দেখভালের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পর্যাপ্ত জনবল নেই। নিয়মিত মনিটরিং করার মতো তেমন উদ্যোগ তাদের কখনো ছিল না। তবে অধিদপ্তর বলছে, যারা শর্তপূরণ করতে পারেনি, তাদের লাইসেন্স নবায়ন হয়নি।
করোনা ভাইরাসের মহামারীর মধ্যে কোভিড চিকিৎসার নামে রাজধানীর রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আসার পর জানা যায়, বৈধ লাইসেন্স
ছাড়া কার্যক্রম চালাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এরপর হাসপাতালগুলোর বৈধ লাইসেন্সের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া কীভাবে রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে কোভিড চিকিৎসার জন্য চুক্তি হলো তা জানতে চেয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দিয়েছে।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের রোগী শনাক্তের পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসতে থাকে। র্যাবের অভিযানে রিজেন্ট হাসপাতালের কেলেঙ্কারির ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর এ জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের দায়ী করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ২০১৮ সালের পর থেকে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন নবায়ন অনেকটা বন্ধ হয়ে পড়ে। ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন ফি ও নিবন্ধন নবায়ন ফি পাঁচ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বনি¯œ ৫০ হাজার ও সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নবায়ন ফি ধরা হয় আড়াই লাখ টাকা। অন্যদিকে বিভাগীয় ও সিটি করপোরেশন এলাকার বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নবায়ন ফি ১০-৫০ শয্যার জন্য ৫০ হাজার টাকা, ৫১-১০০ শয্যার জন্য এক লাখ, ১০০-১৪৯ শয্যার ক্ষেত্রে দেড় লাখ, ২৫০ শয্যার জন্য দুই লাখ টাকা করা হয়।
একই শয্যাসংখ্যার জেলাপর্যায়ের হাসপাতালের জন্য যথাক্রমে ৪০ হাজার টাকা, ৭৫ হাজার, এক লাখ ও দেড় লাখ এবং উপজেলা পর্যায়ের জন্য যথাক্রমে ২৫ হাজার, ৫০ হাজার, ৭৫ হাজার ও এক লাখ টাকা করা হয়। এ ছাড়া আবাসিক এলাকায় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক না রাখার নির্দেশনা থাকার বিষয়টি নবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা আমাদের সময়কে বলেন, ২০১৮ সালে অনলাইনে লাইসেন্স নবায়ন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার পর নবায়ন ফিও বাড়ানো হয়। এরপর থেকেই মূলত লাইসেন্স নবায়ন কমতে থাকে। ওই সময় হাসপাতালগুলো নবায়ন ফি বাড়ানোর আপত্তি জানিয়ে সময় বাড়াতে বারবার চিঠি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সময় বাড়ানো হলেও তার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক আমিনুল হাসান পলাশ বলেন, বর্তমানে ১৫ হাজার বেশি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মধ্যে ৫ হাজারের মতো লাইসেন্স নবায়ন আছে। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, লাইসেন্সের জন্য পরিবেশের ছাড়পত্র, জনবল, সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র, ট্যাক্স সার্টিফিকেটসহ অন্যান্য কাগজপত্র দিতে হয়। এসব কাগজপত্র দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের লাইসেন্স নবায়ন হয়নি। তিনি আরও জানান, তারা নিয়মিত তাদের নোটিশ দিচ্ছেন এবং সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত লোকবলের অভাবে তারা বিষয়গুলো তীক্ষèভাবে পর্যবেক্ষণ করে পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। এ প্রসঙ্গে আমিনুল হাসান বলেন, রাজধানীতে ৫ হাজারের বেশি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এগুলো দেখার জন্য মাত্র তিনজন ব্যক্তি আছেন।
র্যাবের অভিযানে রিজেন্ট হাসপাতালে নমুনা পরীক্ষা ছাড়া করোনা ভাইরাসের মনগড়া টেস্টিং ফল দেওয়ার প্রমাণ পাওয়ায় সিলগালা করা হয়েছে হাসপাতালের উত্তরা ও মিরপুর শাখা। রিজেন্টের নানা অপকর্ম বের হয়ে আসার পর বুধবার অধিদপ্তরের সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়। এ সময় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর লাইসেন্স নবায়ন করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আগে লাইসেন্স নবায়নে দুই সপ্তাহ সময় লাগলেও এখন দুদিনে লাইসেন্স নবায়ন করা হবে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া আমাদের সময়কে বলেন, রিজেন্টের ঘটনার পর হাসপাতালগুলোকে লাইসেন্স নবায়ন করতে বলা হয়েছে। এখন দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। কাজটি তাদেরই করতে হবে।
জানা গেছে, কোভিড-১৯ রোগী বেড়ে যাওয়ায় ২৯টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবকে করোনা পরীক্ষা ও সেবা দেওয়ার অনুমতি দেয় সরকার। এর কয়েকটিরও লাইসেন্স নবায়ন নেই। দৈনিক আমাদের সময় খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে, রাজধানীর ধানমন্ডির তিনটিসহ মগবাজার এবং গুলশান এলাকার একটিসহ সরকারের অনুমতি নিয়ে কোভিড চিকিৎসা দিচ্ছে এমন কয়েকটি হাসপাতালের লাইসেন্স নেই। একটি হাসপাতাল কোভিড পরীক্ষার অনুমতি পেলেও তাদের পিসিআর মেশিন নেই। কোভিড চিকিৎসার জন্য সরকার নির্ধারিত আরও কয়েকটি হাসপাতাল রয়েছে যাদের করোনা রোগীর সেবা দেওয়ার পর্যাপ্ত অক্সিজেন, আইসিইউসহ অন্য সুযোগসুবিধা নেই। তারপরও এসব হাসপাতাল, ক্লিনিককে প্রবল ছোঁয়াছে প্রাণঘাতী এই রোগের চিকিৎসা দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও করোনায় গঠিত কারিগরি পরামর্শ কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বিস্ময় প্রকাশ করে আমাদের সময়কে বলেন, লাইসেন্স নবায়ন ছাড়া হাসপাতাল চলে কীভাবে? তিনি মনে করেন, এ অবস্থার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুই-ই দায়ী। হাসপাতালগুলোর নবায়নে অনীহা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চরম গাফিলতি রয়েছে। কারণ লাইসেন্স নবায়ন এমন একটি প্রক্রিয়া, যা হাসপাতালগুলো করতে বাধ্য এবং না করলে তাদের শাস্তির আওতায় আনা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজ। কিন্তু কেউ তা ঠিকভাবে করছেন না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন