রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে জড়িত প্রতারকদের আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি ভুক্তভোগীদেরকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান। বাংলা ইনসাইডার এর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় এমন মন্তব্য করেন তিনি।
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্যসেবা নাগরিকের কোন আইনি অধিকার নয়, এটা কোন মৌলিক অধিকারও নয়। সুতরাং স্বাস্থ্যসেবা থেকে কেউ বঞ্চিত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও আমাদের কিছু করার নেই, আইন তাঁকে কোনভাবেই সাহায্য করতে পারবে না। আমরা এখনো যতটুকু সেবা পাচ্ছি তা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর বদন্যতায়। কিন্তু এই বদন্যতা কবে আমাদের অধিকারে রূপান্তরিত হবে, সেই জায়গাটা বোধ হয় আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার। যেহেতু স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকারটি স্বীকৃত হয়নি, সেহেতু স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আমাদের আইনি কোন সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে বাধ্য করার কোন ক্ষেত্র এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে তৈরি হয়নি।
পৃথিবীর অনেক দেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন থাকলেও বাংলাদেশে এখনো কেন এই আইন হচ্ছেনা তাঁর উত্তরে মানবাধিকার কমিশনের সাবেক এই চেয়ারম্যান বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশে এই আইন থাকলেও স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পরেও আমাদের এই আইন নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। ১৯৭২ সালের সংবিধান যখন করা হলো তখন নাগরিক এবং রাজনৈতিক অধিকার পূরণকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। কিন্তু আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সামাজিক অধিকারগুলোকে মৌলিক অধিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়নি এবং সেগুলো রাষ্ট্রের মূল নীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। সেই সংবিধানেই আবার বলা হয়েছে যে, এই মূল নীতিগুলো থেকে যদি জনগণ বিচ্ছিন্ন হয়, তখন আপনি আইনের দ্বারস্থ হতে পারবেন না, আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবেন না, আইনি কোন প্রতিক্রিয়া আপনি পাবেন না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এই অবস্থা থেকে অনেক দরিদ্র এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্র ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকারে অন্তর্ভুক্ত করেছে। কিন্তু আমরা এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারিনি।
উদাহরণ দিয়ে অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে ২০১৫ সালে সংবিধানে স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা যখন সংবিধান প্রণয়ন করলেন ১৯৯৪ সালে, তখন সেখানে স্বাস্থ্যসেবা মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।
তিনি বলেন যে, যখন আমি মানবাধিকার কমিশনের দায়িত্বে ছিলাম তখন অর্থনৈতিক সামাজিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার বেশ চেষ্টা করেছিলাম এবং একটি কথা বারবার রাষ্ট্রকে বোঝাতে চেষ্টা করেছি যে, অন্তত পক্ষে কিছু কিছু অধিকার পর্যায়ক্রমে মৌলিক অধিকারে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। রাষ্ট্রকে সেগুলোর দায়িত্ব নিয়ে নেওয়া উচিত। বর্তমানে বাংলাদেশে যে অবস্থানটা বিদ্যমান সেখানে আপনি যতটুকু সামাজিক নিরাপত্তা পাচ্ছেন তা হচ্ছে শুধুমাত্র একজন প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণে। যিনি জনদরদী হিসেবে পরিচিত এবং তিনি ক্ষমতায় আছেন বিধায় নিরাপত্তার কিছু কিছু বিষয় আপনাকে স্পর্শ করছে। ধরুন আপনি যদি বয়স্ক হয়েও বয়স্ক ভাতা না পান তাহলে আপনি আইনের দ্বারস্থ হতে পারবেন না। এই জায়াগাটিতেই সঙ্কট। তাই আমি মনে করি কিছু কিছু অর্থনৈতিক সামাজিক অধিকারগুলোকে মৌলিক অধিকার হিসেবে যুক্ত হওয়া একান্তই প্রয়োজন এবং মহামারির সময় আমরা সহজেই বুঝতে পারছি যে, আমাদের স্বাস্থ্যখাতের এই বেহাল দশা থেকে উত্তরণ পেতে হলে রাষ্ট্রকে আরো বেশি দায় নিজের কাঁধে নিতে হবে। সৎ মানুষদের স্বাস্থ্যখাতে বসাতে হবে এবং তাঁরা দূর্নীতি করলে তাঁদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করতে হবে। যেন শক্ত একটি বার্তা সকলেক্ষেত্রে পৌঁছানো যায় যে, একটি দরিদ্র দেশে দরিদ্র মানুষের জীবন নিয়ে কেউ হেলাফেলা করতে পারবে না এবং রাষ্ট্র তা সহ্য করবে না।
জেকেজি-রিজেন্টের মতো প্রতারকরা প্রতারণা করে আইনের আওতায় আসলেও ভুক্তভোগী নাগরিকরা যারা প্রতারিত হয়েছেন, যারা লক্ষাধিক টাকা দিয়ে ভূয়া চিকিৎসা নিয়েছেন বা যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাঁদের জন্য প্রতিকার কি? এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন যে, বর্তমান আইনবিজ্ঞানে সকল মনোযোগ চলে যাচ্ছে ‘ভিকটিম সেন্টারড এক্সপ্রেশন অব জাস্টিজ’ এর দিকে। আমাদের ভুক্তভোগীর দিকে মনোযোগ দিতে হবে এবং মাথায় রাখতে হবে যে, শুধুমাত্র অপরাধীকে দণ্ড দেওয়াটাই যথেষ্ট নয়। আমাদের ভুক্তভোগীর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এজন্য এইসব ভূয়া চিকিৎসার জন্য যেসকল মানুষরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, শুধুমাত্র তাঁদের খরচকৃত টাকা ফেরত দেওয়াই নয়, একইসঙ্গে ভুক্তভোগীরা যে হয়রানির শিকার হয়েছে এজন্য তাঁদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে যেন ভুক্তভোগীদের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে পারে। যদি ভুক্তভোগীর মৃত্যু হয় তাহলে তাঁর পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং এই ক্ষতিপূরণ রাষ্ট্রকে আদায় করতে হবে এর সঙ্গে জড়িত দুর্নীতিবাজদের কাছ থেকে। রাষ্ট্রকে ভুক্তভোগীর দায়িত্ব নিতে হবে এবং এই ক্ষতিপূরণ বুঝিয়ে দিতে হবে। এজন্য আমাদের আদালতকেও দৃষ্টির বিস্তীর্ণতা বাড়াতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের স্বার্থে কিভাবে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন সেক্ষেত্রে আদালতকেও একটু বিস্তারিতভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে।
২০১৪ সালে রিজেন্ট হাসপাতালের অনুমোদন বাতিল হওয়ার পরেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যারা এই চুক্তি করলো বা যারা এই হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসা করার অনুমতি দিয়েছে তাঁদেরকেও বিচারের আওতায় আনা উচিত কিনা এবং আনতে কি কি বাঁধা রয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরে অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, যারা এই চুক্তি করেছে তাঁরা অবশ্যই অপরাধ করেছে এবং এটা বড় রকমের প্রতারণা। ইতিমধ্যে এর সঙ্গে যুক্ত থাকা সকলকে আইনের আওতায় আনা উচিত ছিল।
অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান আক্ষেপ করে বলেন যে, আমাদের দেশের আপামর সাধারণ মানুষ কিন্তু উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারছে না। তাঁরা নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করছে। অথচ যারা এই জনগণের টাকায় বেতন পাচ্ছে এবং জনগণকে হয়রানি করছে, কিন্তু তাঁরা ঠিকই কিছু হলেই বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমার অনুরোধ এই যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এই সকল দুর্নীতিবাজদের সরিয়ে দিন। আমি জানিনা দুর্নীতি দমন কমিশন কিসের অপেক্ষায় বসে আছে বা কবে এসকল দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে। তাঁদের শুধুমাত্র উচাবাচ্চ্য শুনছি। তবে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছেনা। এটা সাংঘাতিক রকমের ক্ষোভের সঞ্চার করছে জনসাধারণের মনে। তাই এসব দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অতি শীঘ্রই ব্যবস্থা নিতে হবে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাদের।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন