নভেল করোনা ভাইরাসে গোটা যুক্তরাষ্ট্র যখন নাস্তানাবুদ, যখন প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুতে মৃত্যুপুরী হয়ে উঠেছিল দেশটি, সেই সময়ে যেন কোনও হলিউড তারকার মতো করোনা নামক খলনায়কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ডা. ফেরদৌস খন্দকার। বিশ্বখ্যাত নায়ক নায়িকারা যখন করোনার তাণ্ডবে ঘরবন্দি তখন মহানায়কের মতো ডা. ফেরদৌসের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল নিউইয়র্কের পথে পথে। কারণ একটি, সেখানে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবায় তার নিরলস প্রচেষ্টা ও সফলতা।
এরপরই সেই করোনা ভাইরাস আমাদের প্রিয় বাংলাদেশেও হানা দিলো। এবার দেশের পানে ফিরে তাকালেন তিনি। সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে, করোনার এই কঠিন বাস্তবতায় দেশের মানুষকে একটু সেবা দিতে সুদূর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরলের জন্মভূমিতে। এ খবর মার্কিন গণমাধ্যমগুলোতেও বোল্ট করে প্রকাশ করা হয। কিন্তু এত পথ পাড়ি দিয়ে দেশে ফিরে প্রতিদানে কি পেলেন? গত ৭ জুন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পা রাখার পরই ডা. ফেরদৌসকে বনানীতে নিজ বাসায় যেতে না দিয়ে তাকে বাধ্য করা হয় হজ ক্যাম্পের ৭ তলায় ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে।
সেই কোয়ারেন্টাইন থেকে মুক্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক মাউন্ট সিনাই হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ফেরদৌস খন্দকার গত ২১ জুন সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন। আসুন পাঠক সেই স্ট্যাটাসটি থেকে ডা. ফেরদৌসকে আবিষ্কারের চেষ্টা করি।
“অবশেষে কোয়ারেন্টাইন মুক্ত হলাম আমি। কেটে গেলো ১৪টি দিন। সময়তো কাটবেই। থেকে যাবে কেবল স্মৃতি। এই মুহূর্তে কোন অভিযোগ নয়, কেবল ধন্যবাদই দিতে চাই সবাইকে। যারা গত ১৪টি দিন আমার সাথে ছিলেন। বিভিন্নভাবে সহায়তা দিয়েছেন, মানসিকভাবে শক্ত থাকতে প্রেরণা জুগিয়েছেন। তবে একথা আমাকে বলতেই হবে যে, শুরুটা বেশ কঠিনই ছিল আমার জন্যে। আমার বিরুদ্ধে "অহেতুক" এবং "মিথ্যা অভিযোগে" বিরাট ঝড় উঠেছিল। সব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ঝড়ও হয়তো থেমে গেছে।
যা বলছিলাম, দেশে আসার পর আমাকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে দেয়া হয়েছে; এই বিষয়টি আমি প্রথম পাঁচদিন মানতেই পারছিলাম না। কেননা আমার এন্টিবডির সনদ ছিল। তখন মানসিকভাবে রীতিমতো বিদ্ধস্ত হয়ে পড়েছিলাম। পরিবার, সহকর্মী, বন্ধু, সুধীজন, সহযোদ্ধারা, সাংবাদিক এবং দেশের মানুষের সহায়তা ও সমর্থণ আমাকে সাহস জুগিয়েছে।
দেশে এসেছিলাম কয়েক সপ্তাহ দেশবাসীর জন্যে কাজ করবো বলে। সাথে ছোট্ট একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তুলে যাবো, এমন আশা ছিল। সেই লক্ষ্যেই দুই থেকে তিন সপ্তাহের জন্যে এসেছিলাম। যদিও সময় কিছুটা ক্ষেপন হয়ে গেছে। এরপরও আমি মনে করি, কোন আক্ষেপ নেই আমার। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কিছুটা কাজ করে যাবো। তবে সাথে নিয়ে যাবো গত দুটি সপ্তাহে ঘটে যাওয়া অনেক কিছু ও অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে যেসব সৈনিক ভাইয়েরা আমার সাথে ছিলেন, তারা অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন। অনেক সহযোগিতা করেছেন। আপনাদের মমতা কোনদিন ভুলবার নয়। সেই সাথে কুয়েত প্রবাসী কিছু ভাই শেষের দিকে কোয়ারেন্টাইনে যোগ দিয়েছিলেন। তাদের ভালোবাসায় ভরা স্মৃতিগুলোও বাকি জীবন আমার সাথে থাকবে। কখনো যদি দেখা হয়, নিশ্চয়ই ভালো লাগবে; বুকে জড়িয়ে ধরবো আপনাদের। দেখা না হলেও, আপনাদেরকে আমার সবসময় মনে থাকবে।
দেখুন আমি অতি সাধারণ একজন চিকিৎসক। তবে দেশকে, দেশের মানুষকে খুব ভালোবাসি। এসেছিলাম, দূর্যোগের এই সময়টায় কেবলই দেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। কোন রাজনৈতিক অভিলাষ বা ইচ্ছা আমার ছিল না; নেইও। ফলে যারা তেমনটি ভেবেছিলেন, আশা করছি আপনাদের ভুলটা ভেঙেছে। বাংলাদেশের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও সম্মুখসারির যোদ্ধারা করোনার এই সময়টায় রীতিমতো জীবন বাজি রেখে লড়াই করছেন। তাদের আত্মত্যাগ, এই জাতি সবসময়ই মনে রাখবে। সামনের দিনগুলোতেও তারা এমনিভাবে লড়ে যাবেন বলে আমার বিশ্বাস।
আমি এই মুহূর্তে স্বাস্থ্য বিষয়ক ছোট্ট একটি সেটআপ শুরু করবো। কারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। মায়ের বিরুদ্ধে সন্তানের কোন অভিযোগ থাকে না। আমারো নেই। আবারো দেখা হবে। ভালোবাসা বাংলাদেশ। সবাই ভালো থাকুন। নিরাপদে থাকুন। আপনাদের মঙ্গল হোক।
এর আগে গত ৭ জুন দেয়া এক স্ট্যাটাসে ডা. ফেরদৌস খন্দকার লিখেছিলেন- প্রিয় বাংলাদেশ। দেশে এসেছিলাম নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কারোনা নিয়ে সবার পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করতে। তার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতেও আমি পিছপা হইনি।
যখন ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে আমি দেশে এসেছি, তখন একদল লোক আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার শুরু করেছে। বলা হচ্ছে, আমি নাকি খুনি খন্দকার মোশতাকের ভাতিজা/ভাগনে কিংবা খুনি কর্নেল রশিদের খালাতো ভাই। অথচ পুরো বিষয়টি কাল্পনিক।
আমার বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বারে। কুমিল্লায় বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের বাড়ি। কুমিল্লা বাংলাদেশের একটি স্বনামধন্য জেলা। কুমিল্লায় বাড়ি হলেই কেউ খুনি মোশতাকের ভাতিজা কিংবা কর্নেল রশিদের খালাতো ভাই হয়ে যায় না। আমি স্পষ্ট করে বলছি, এই দুই খুনির সঙ্গে আমার পারিবারিক কিংবা আদর্শিক কোনো সম্পর্ক নেই। বরং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক হিসেবে আমি তাদেরকে চরম ঘৃণা করি।
যারা এই খারাপ কথাগুলো ছড়াচ্ছেন, বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার; ভালো কাজে বাধা দেয়া। এটা অন্যায়। আমি তীব্র প্রতিবাদ ও ঘৃণা জানাচ্ছি। সেইসঙ্গে প্রমাণের জন্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছি। যদি মনে করেন আমার সেবা আপনাদের দরকার, তাহলে পাশে থাকুন।”
গত ৭ জুন ঢাকা পা রাখার পরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডা. ফেরদৌসকে নিয়ে নানা গুঞ্জন ও গুজব ছড়ানো শুরু হয়। বলা হচ্ছিল, তিনি বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার মোশতাকের ভাগনে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ব্যবসায়িক অংশীদার। বলা হচ্ছিল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়ালেখা করার সময় তিনি ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এসব খবর ধীরে ধীরে গণমাধ্যমেও আসতে শুরু করে।
কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে মানুষটি আমেরিকার মহানায়ক হয়ে উঠেছিলেন তাকেই কিনা বাংলাদেশের কিছু মহল এভাবে তাচ্ছিল্য করলো? যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা ডা. ফেরদৌসের করোনাকালীন বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বারবার করে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। তারপরও তাকে অবমূল্যায়িত হতে হলো।
বিশেষত, ডা. ফেরদৌস খন্দকারের অতীত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি আলোচনায় উঠে এলেই গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তার ওপর নজর রাখতে শুরু করেন।
ডা. ফেরদৌস কি আসলেই মুজিব হত্যাকারী খুনি খন্দকার মোশতাকের ভাগনে? আসুন পাঠক একনজরে ডা. ফেরদৌসের মামাদের পরিচয় জেনে নিই। ডা. ফেরদৌসের ৬ জন মামা। তার মধ্যে সবার বড় খোরশেদ আনোয়ার একজন ফার্মাসিস্ট ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। দ্বিতীয় মামা রেজাউল করিমও মুক্তিযোদ্ধা। তৃতীয় মামা মনজুর মোর্শেদ থাকেন টেক্সাসে। চতুর্থ মামা আবেদ মনসুর নিউইয়র্ক প্রবাসী, তিনিও পেশায় ফার্মাসিস্ট। পঞ্চম মামা যাকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনাটা বেশি হয়েছে তার নাম ইঞ্জিনিয়ার মোস্তাক আহমেদ। তিনি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। থাকেন বোস্টনে। এই মোশাতাক কিন্তু ‘সেই মোশতাক’ নয়। আর সবার ছোট মামা খন্দকার সাখাওয়াত হোসেনও নিউইয়র্ক প্রবাসী, পেশায় ব্যবসায়ী।
ডা. ফেরদৌসের বাবা ফয়েজ আহমেদ খন্দকার বিমান বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন। মা আনোয়ারা বেগম খন্দকার একজন গৃহিণী। ডা. ফেরদৌসের দুই বোন রয়েছে। ফারাহ জেবা খন্দকার, ফ্লোরিডা প্রবাসী। স্বামী ডা. তানজীমও সেখানেই থাকেন, পেশায় ফার্মাসিস্ট। দ্বিতীয় বোন চাঁদনী একজন ফ্যাশন ডিজাইনার।
সাবেক অনেক ছাত্রলীগ নেতাই বলেছেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়ালেখার সময় ছাত্রলীগের দুঃসময়ের কর্মী ছিলেন ডা. ফেরদৌস। তিনি কোনও খুনির ভাগনে কিংবা আত্মীয় নন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৩২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ডা. সাইফুল ভূঁইয়া বলেন, ‘কলেজ জীবনেই সে আমার রাজনৈতিক সহযোদ্ধা ছিল। রাজপথে অনেক মিছিল মিটিংয়ের কণ্ঠস্বর ছিল সে। তখন ছাত্রলীগের কঠিন সময়ে আমরা অনেকেই ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয়ে শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে মেস ভাড়া করে থাকতাম। অনেকেই বাড়িভাড়া করে থাকতাম। তখন আমাদের সঙ্গে ডা. ফেরদৌসও ছিল। সে আমার রুমমেট ছিল।’
ডা. ফেরদৌস দেশকে কিছু দেয়ার সুযোগ না পেয়ে একবুক লাঞ্ছনা নিয়ে নিউইয়র্কে ফিরে গেছেন। এখন অনেকেই বলাবলি করছেন, যদি তিনি খুনির আত্মীয় না-ই হন, তবে তার মতো একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা থেকে দেশের এই দুঃসময়ে বঞ্চিত হলো দেশবাসী।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন