দেশে মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের ১২০ দিন পূর্ণ হচ্ছে আগামীকাল। তবে করোনা মোকাবেলায় এক জায়গাতেই ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশ। কখনো সাধারণ ছুটি আবার কখনো অঞ্চলভিত্তিক লকডাউন। এ সময়ে সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী, নেই কমার কোনো লক্ষণ। জটিল হয়ে পড়েছে চিকিৎসাসেবা। করোনা বা অ-করোনা দুই ধরনের রোগীর ক্ষেত্রেই চিকিৎসাসেবা আতঙ্ক ও উদ্বেগের পর্যায়ে পৌঁছেছে। অনেক কষ্টে পরীক্ষা করাতে পারলেও শনাক্ত হওয়ার পর অনেকে হাসপাতালে যেতে চাচ্ছে না। অ-করোনা রোগীদের অনেকেই ঘুরছেন বিভিন্ন হাসপাতালে। সমস্যা সমাধানে বড় কোনো আন্তরিক উদ্যোগ মানুষ দেখতে পাচ্ছে না। এজন্য সবাইকেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
এ পর্যন্ত কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়েছেন মোট এক লাখ ৫৯ হাজার ৬৭৯ জন, সুস্থ ৭০ হাজার ৭২১ জন আর মারা গেছেন ১ হাজার ৯৯৭ জন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলেছেন, সংক্রমণ বাড়ার এই ধারা লম্বা সময় ধরে চলতে পারে। তবে কবে থেকে তা কমতে শুরু করবে তা এখনো ধারণা করতে পারছেন না বিশ্লেষকরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রথম সংক্রমণের দেশ চীনে তিন মাসের মধ্যেই সংক্রমণ কমতে শুরু করেছিল। দক্ষিণ কোরিয়াতেও নিচের দিকে নামতে শুরু করেছিল সংক্রমণের হার। অন্যান্য দেশগুলো যেমন ইউরোপে এখন সংক্রমণের মাত্রা নিচের দিকে চলে এসেছে এবং সেখানে তা তিন মাসের মধ্যেই সম্ভব হয়েছে। কিন্তু চার মাস পর বাংলাদেশে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী।
বিশ্লেষকরা বলছেন, লকডাউনের মতো বিধিনিষেধ শিথিল করার পর থেকে দেশে সংক্রমণ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। লোকসমাগম ও যাতায়াত যত বেশি হবে কোভিড-১৯ তত বেশি ছড়ানোর শঙ্কা রয়েছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দ্রুত এলাকাভিত্তিক লকডাউন কার্যকর করার পরামর্শ দেন তারা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য এবং করোনাবিষয়ক টেকনিক্যাল কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেছেন, ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সবার সচেতনতা ছাড়া এ মুহূর্তে কোনো বিকল্প নেই। এতে নিজের পরিবার এবং জনগণ, সবাই এ মহামারির হাত থেকে রক্ষা পাবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেছেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্যই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর থেকে সতর্কতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখন পৃথিবীতে ভ্যাকসিন না আসা পর্যন্ত আসলে এটা কোন দিকে মোড় নেবে, তা বলা কঠিন।
এদিকে সরকারের একাধিক নীতি নির্ধারক বলেছেন, তারাও মনে করেন, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এই পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হতে পারে। তবে তাদের দাবি, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করেই তারা পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, এ ভাইরাস আগামী দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত থাকবে। তবে সংক্রমণের মাত্রা কমে আসবে। জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য রাখার জন্য সরকার কাজ করে চলেছে। সরকারকে সাহায্য করতে হলে জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
করোনা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার কিছুদিন পর থেকে বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশ এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য গবেষণা চালাচ্ছে। এরইমধ্যে এখন পর্যন্ত অনেকগুলো ভ্যাকসিনকে পরীক্ষামূলকভাবে মানবদেহে প্রয়োগও করা হয়েছে। তবে এদের মধ্যে কোনোটিই এখনও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুমতি পায়নি। করোনার উৎসস্থল চীনে মোট ৮টি ভ্যাকসিন মানব পরীক্ষার অনুমতি পেয়েছে। এছাড়া অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি ভ্যাকসিনটির তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চলছে।
বাংলাদেশে এরই মধ্যে আশার খবর শোনাল স্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা গ্লোব বায়োটেক। তাদের দাবি, প্রথমবারের মতো কোভিড-১৯ রোগের টিকা ভ্যাকসিন আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। ইতোমধ্যে পশুর শরীরে প্রাথমিকভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে সাফল্যও পাওয়া গেছে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, পশুর শরীরে আরেকটি রেগুলেটরি ট্রায়াল চালানো হবে। এর জন্য ৬-৮ সপ্তাহ সময় লাগবে। এরপরেই মানবদেহে প্রয়োগের জন্য কাজ শুরু করা যাবে বলে তাদের আশা।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই দেশে কোভিড-১৯ টেস্ট বিনামূল্যে হওয়ায় অধিকাংশ মানুষ উপসর্গ ছাড়াই পরীক্ষা করার সুযোগ গ্রহণ করেছে। এমন পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য অপ্রয়োজনীয় টেস্ট পরিহার করার লক্ষ্যে ফি নির্ধারণ করেছে সরকার। গত ২৮ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বুথ থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষায় ২০০ টাকা, বাসা থেকে সংগৃহীত নমুনায় ৫০০ টাকা ও হাসপাতালে ভর্তি রোগীর নমুনা পরীক্ষায় ২০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।
করোনা পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ মানুষকে সরকারি হাসপাতাল ও বুথ থেকে দূরে রাখবে। দরিদ্র মানুষ পরীক্ষার সুযোগ কম নেবে। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
কোভিড-১৯ শুধু একটি স্বাস্থ্যসমস্যা নয়, এটি সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগতসহ সামগ্রিক অভ্যাস ও রীতিনীতিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। করোনা মহামারির কারণে প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। দেশের সকল জেলা ও বিভাগের প্রায় ৩০ হাজার মানুষের ওপর জরিপ পরিচালনা করে এই তথ্য প্রকাশ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)।
প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, কোভিড-১৯-এর কারণে মানুষের আয় কমে গেছে, বেকারত্ব বেড়েছে, বিশেষ করে যাদের আয় কম, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। পাঁচ হাজার টাকার কম আয় করেন তাদের ১৯ দশমিক ২৩ শতাংশ জানিয়েছেন তাদের আয় ৭৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, পাঁচ হাজার থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে আয় করেন তাদের ২৩ দশমিক ৩১ শতাংশ জানিয়েছেন গত মাসের আয়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ আয় কমে গেছে।
এদিকে, কোভিড-১৯ এর প্রভাবের কারণে গ্রামাঞ্চলে এসএমই উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, কারণ আগের বছরের তুলনায় ২০২০ সালে তাদের আয় ৬৭ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন