বাজেট দিয়ে অর্থমন্ত্রী চিকিৎসার জন্যে লন্ডনে চলে গেছেন। করোনা নিয়ে যখন জনস্বাস্থ্যের বেহাল দশা, অর্থনীতি নিয়ে শঙ্কা, সেসময় বাজেটের পরপরই অর্থমন্ত্রীর চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বিদেশ ভ্রমণ নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। যে প্রশ্নটি বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আলোচিত হয় তা হলো আমাদের দেশের সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি ভিআইপিরা আস্থাশীল নন। ভিআইপিরা যদি বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান তাহলে সাধারণ মানুষের কি হবে?
বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নেয় শুধুমাত্র গরীব মানুষরা। অথচ বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, মন্ত্রী থেকে শুরু করে ভিআইপিরা সেদেশের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। আমাদের দেশে একমাত্র ব্যতিক্রম হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তাঁর চোখ পরীক্ষা করাতে যান জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে। সেখানে তিনি পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে চক্ষু পরীক্ষা করান এবং দেশের চিকিৎসার প্রতি তাঁর আস্থা অগাধ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আদর্শ অনুসরণ করার কথা বলে মুখে ফেনা তুললেও বাংলাদেশের অধিকাংশ নেতাকর্মীরাই একটু কিছু হলেই বিদেশে চিকিৎসা জন্য যান। যার সবশেষ উদাহরণ অর্থমন্ত্রী। শুধু অর্থমন্ত্রী নয়, আমরা যদি ফিরে দেখি যে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত বছর ডেঙ্গু প্রকোপের সময় মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন চোখের চিকিৎসার জন্য। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন সময় চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান। শুধুমাত্র মন্ত্রী-এমপিরাই নন বিরোধী দলের নেতারাও চিকিৎসার জন্যে দেশের সরকারি হাসপাতালা ব্যবস্থার উপর আস্থাশীল নন। বেগম খালেদা জিয়া বিদেশে চিকিৎসার জন্যে আর্তনাদ করছেন। যেন দেশে তাঁর কিছুই হবেনা।
দেশে কোন চিকিৎসা নেই এই কথা বিএনপির পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছে। বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও চিকিৎসার জন্যে কখনো ব্যাংকক যান, কখনো সিঙ্গাপুরে যান। বিএনপির আরেক নেতা মোর্শেদ খান করোনার সঙ্কটের সময় চিকিৎসার জন্যে চলে গেছেন লন্ডনে। বিএনপির পাতি নেতা থেকে শুরু করে উপনেতারা পর্যন্ত দেশে চিকিৎসা নেন না, হাঁচিকাশি হলেও বিদেশে চলে যান।
অর্থাৎ আমাদের রাজনীতিবিদদের মাঝে একটি অলিখিত সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে যে তাঁরা সরকারি হাসপাতালে যান না, সবসময় চিকিৎসা নেন অন্য হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না করানোর ফলে দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর যে ছন্নছাড়া দশা তা এবার করোনা সংক্রমণের সময় প্রমাণিত হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ নেই, নূন্যতম চিকিৎসা সেবা নেই যার বড় কারণ হলো জবাবদিহিতার অভাব। আর জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজন সরকারি হাসপাতালে যাওয়া।
প্রধানমন্ত্রী যখন জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটে তাঁর চক্ষু পরীক্ষা করাতে যান তখন জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের খোল-নকশা পাল্টে যায় এবং সেবার মান বাড়ে। এটাই হলো বাস্তবতা।
আওয়ামী লীগের অনেক নেতা চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজের উপর নির্ভরশীল। ওবায়দুল কাদের অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে গিয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। জাহাঙ্গীর কবির নানক অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজে চিকিৎসার জন্যে গিয়েছিলেন। একারণে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ অন্যান্য হাসপাতালগুলোর থেকে উন্নত। কিন্তু কথায় কথায় বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করার যে সংস্কৃতি সেই সংস্কৃতি থেকে যদি আমাদের ভিআইপি এবং রাজনীতিবিদরা বের হয়ে আসতে না পারেন তাহলে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার খুব একটা উন্নতি আশা করা যায়না।
আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অনেক সঙ্কট আছে, অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক ভালো নাম করা চিকিৎসক আছেন যারা আন্তজার্তিক খ্যাতিসম্পন্ন। আমাদের ভিআইপিরা যখন সরকারি হাসপাতালের উপর আস্থা রাখেন না তখন জনগণ সরকারি হাসপাতালের উপর আস্থা রাখবে কিভাবে? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, কিন্তু তিনি কোন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাননি, তিনি গিয়েছেন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে। প্রশ্ন উঠেছে কেন? তাহলে কি কুর্মিটোলা কোভিড সেন্টার, কুয়েত মৈত্রী কোভিড সেন্টার অথবা ঢাকা মেডিকেলের কোভিড সেন্টারের উপর তাঁর আস্থা নেই? তাই আমরা যদি স্বাস্থ্যখাতকে সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন করতে চাই, জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা করতে চাই এবং স্বাস্থ্যখাতে একটি জবাবদিহিতা আনতে চাই তাহলে আমাদের যারা ভিআইপি আছেন, যারা মন্ত্রী আছেন, এমপি আছেন বা বিরোধী দলীয় নেতা আছেন তাঁদেরকে দেশের চিকিৎসার ব্যাপারে আস্থাশীল হতে হবে এবং দেশেই চিকিৎসা নিতে হবে।
এই করোনা সঙ্কট আমাদের একটি নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছে তা হলো আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত করতেই হবে। আর এই কারণে কথায় কথায় বিদেশে চিকিৎসার যে প্রবণতা, সেই প্রবণতা আমরা যত দ্রুত বন্ধ করতে পারবো, যত দ্রুত দেশের সরকারি হাসপাতালের উপর আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা নির্ভরশীল হতে পারবেন তত দ্রুত বাংলাদেশে চিকিৎসার মান উন্নত হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন