গত ২৮শে মে লিবিয়ায় অপহরণকারীদের গুলিতে অভিবাসন প্রত্যাশী ২৬ জন বাংলাদেশি নিহত হন। এছাড়া আরো ১১জন আহত হয়ে লিবিয়ার কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা জানিয়েছেন, লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার জন্য দালালের মাধ্যমে বিদেশ পাড়ি জমান তাদের স্বজনেরা।
কিন্তু দালালের সাথে চুক্তি অনুযায়ী লিবিয়ায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই অপহরণের শিকার হয়ে, অপহরণকারীদের গুলিতে নিহত হন ওই ২৬জন বাংলাদেশি।
'অপহরণ করে মুক্তিপণ চাইছে, মাইরা ফালানোর আগে বহু মারধরও করছে'
বৃহস্পতিবার লিবিয়ায় নিহত বাংলাদেশিদের একজন ছিলেন জুয়েল হোসেন। মাদারীপুরের রাজৈরের হোসেনপুর বিদ্যানন্দী গ্রামের বাসিন্দা জুয়েলের ভাই লিটন হোসেন বলছিলেন, দালালের সাথে সাত লাখ টাকার চুক্তি হয়েছিল।
দালাল বলেছিল লিবিয়া পর্যন্ত চার লাখ টাকা দিতে হবে, আর ইতালি পৌঁছনর পর বাকি তিন লাখ টাকা দিতে হবে।লিটন হোসেন নিজেও মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন।
"লিবিয়া গিয়ে বেনগাজী থেকে ত্রিপলি যাওয়ার পথে কিছুদিন ওদের এক জায়গায় রাখছিল দালাল, কিন্তু এর মধ্যে করোনার কারণে সীমান্ত বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মিজদার কাছে এক জায়গায় প্রায় চার মাস লুকাইয়া থাকতে হয় ওদের। এর মধ্যে দালাল ওদেরকে আরেক দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়।"
অপহরণের শিকার হবার আগে বাড়িতে ফোন করে এসব তথ্য জানিয়েছিলেন জুয়েল। তার ভাই জানিয়েছেন, এর কয়েকদিনের মধ্যেই তার ভাইসহ এই দলটি অপহৃত হয়।
"অপহরণ যারা করছে, তারা সবাইরে খুব মাইরধর করছে, কারেন্টে শক দিয়া তারপর ফোন দিছে আমাদের, বলছে দশ লাখ টাকা দিতে হবে, না হলে আমার ভাইরে মাইরা ফেলবে। ঘটনার দুইদিন আগেও কথা হইছে, খুব কান্নাকাটি করতেছিল ভাই।""ইমোতে কল করছিল তারা, ইমোতেই আমার ভাইরে এবং সাথের লোকদের মারধরের ভিডিও পাঠাইছিল। আমরা টাকাপয়সা জোগাড় করতে ছিলাম, কিন্তু এর মধ্যেই তো পাইলাম দুঃসংবাদ।"
লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানিয়েছেন, মারা যাওয়া ২৬ জন সহ মোট ৩৮ জন বাংলাদেশি ও কয়েকজন সুদানি নাগরিক প্রায় ১৫ দিন ধরে ঐ অপহরণকারী চক্রের হাতে আটক ছিলেন।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী এই মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক কোটির বেশি প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা কম-বেশি ২০ লাখের মতো। এর মধ্যে একটি অংশ ইউরোপের দেশ ইতালি ও গ্রিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে লিবিয়া পাড়ি জমান।
'দালালরা পাগল করে ফেলছিল, বসতভিটা-জমি বন্ধক রেখে টাকা দিছি'
মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করতে যাওয়া বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকদের বড় অংশটি অদক্ষ শ্রমিক, এবং প্রায়শই তাদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে।
সেই সঙ্গে দালালদের মাধ্যমে বিদেশে গিয়ে প্রায়ই অনেককে প্রতারণার শিকার হতে হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
কিন্তু তবু দালালদের মাধ্যমে বিদেশে যাওয়া থেমে নেই।রাজৈরের আরেক বাসিন্দা শাহাদাত আকনের ছোট ভাই আসাদুল আকন ইন্টারমিডিয়েট পড়তে পড়তে পাড়ার পরিচিত এক ব্যক্তির কাছ থেকে বিদেশে যাবার প্রস্তাব পান।
২৮শে মে লিবিয়ায় অপহরণকারীদের হাতে খুন হওয়া ২৬ জনের একজন আসাদুল।
মি. আকন বলছিলেন ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে পরিবারকে অনেক বুঝিয়ে, শেষ পর্যন্ত বসত ভিটা, জমি সব বন্ধক রেখে টাকা জোগাড় করে ইতালির উদ্দেশ্যে লিবিয়া যান আসাদুল।
"দালালরে আমরা চিনি, মানে আসাদুলের বন্ধুর চাচা হয়, আমাদের পাশের গ্রামে বাড়ি। আমাদের তো টাকা নাই, দালাল বলছিল যে ভাগে ভাগে টাকা দিলেই হবে, একবারে দিতে হবে না। আর ইতালি পর্যন্ত মোট সাত লাখ টাকা লাগবে সেটাও দুই ভাগে দিতে হবে।"
"আমাদের বসতভিটা, জমি সব বন্ধক রাখছি, দালাল বলছে ইতালি গেলে লাখ টাকা কামাইতে কয়দিন লাগবে, ভাইও পাগল হইছে, তারপর আমরাও ভাবছি ঠিকই তো গেলে আমাদের পরিবারের অবস্থা বদলাইয়া যাবে।"
কিন্তু লিবিয়া যাওয়ার পর যখন তারা কয়েকমাস আটকে ছিলেন, সে সময় দালাল একদফা ফোন করে বলছে ৫০ হাজার টাকা পাঠাতে।
আরেক দফা জমি বন্ধক দিয়ে সে টাকা হুন্ডি করে পাঠিয়েছে মি. আকনের পরিবার।
আসাদুল অপহৃত হবার পর অপহরণকারীরা ফোন দিয়ে দশ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়েছে, সে সময় তার ভাইকে মারধরসহ নানা ধরণের অত্যাচার করা হয়েছে। "আমাদের ওইসবের সাউন্ডও পাঠাইছে। কিন্তু মাইরা ফেলবে সেটা বুঝি নাই।"
শুক্রবার শাহাদাতসহ কয়েকজন ওই দালালের বাড়ি গিয়েছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতি টের পেয়ে ওই লোক তার আগেই পালিয়ে যায়।
দালাল গ্রেপ্তার, র্যাব বলছে 'মূল হোতা'
লিবিয়ায় অপহরণকারীদের গুলিতে নিহত ২৬ জন বাংলাদেশিকে মানব পাচারের সাথে জড়িত সন্দেহে ঢাকায় একজন আদম ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব।
র্যাবের একজন পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল রকিবুল হাসান জানিয়েছেন, রোববার রাতে ঢাকার শাহজাদপুর এলাকা থেকে কামাল উদ্দিন নামে ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
লিবিয়ায় নিহত বাংলাদেশিদের কয়েকজনকে কামাল উদ্দিন পাঠিয়েছিলেন বলে জানিয়েছে র্যাব।
এখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে।
তিনি জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তি একটি দালাল চক্রের মূল হোতা, এরা দরিদ্র পরিবারগুলোকে প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধভাবে বিদেশে নেবার নামে অর্থ হাতিয়ে নিত।
এছাড়া হুন্ডিসহ নানা ধরণের প্রতারণার সঙ্গে এই চক্রটি জড়িত বলে তারা জানতে পেরেছেন বলে জানিয়েছেন র্যাব কর্মকর্তা।
২৮শে মে সকালে লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে প্রত্যন্ত মিজদা অঞ্চলে মানব পাচারকারীদের কাছ থেকে অপহরণের শিকার হন ৩৮ জন বাংলাদেশি।
এদিকে, র্যাব কর্মকর্তা মি. হাসান জানিয়েছেন পাচারকারী চক্রের অন্য সদস্যদের গ্রেপ্তার এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবার প্রক্রিয়া চলছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন