উন্নত দেশ মানেই উন্নততর জীবনযাপন। আর ইউরোপের কথা শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে কত শত রঙিন স্বপ্ন। মোহবন্ধনের হাতছানি। এমন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গৃহযুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ক্রমবর্ধমাণ বেকার সমস্যা, মৌলিক চাহিদাপূরণে ব্যর্থতা থেকেই ইউরোপে নতুন জীবনের স্বপ্ন জাগে।
কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৈধ উপায়ে অভিবাসন সম্ভব নয়। তখন পা মাড়াতে হয় ঝুঁকির পথে। সেই যাত্রায় কেউ সাগরে ডুবে প্রাণ হারান, কেউ অবৈধভাবে সীমান্ত পার হতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নির্যাতনের শিকার হন, অনেকেই আবার পড়েন অপহরণকারীর খপ্পরে।
ইউরোপের দেশ ইতালি যাওয়ার পথে লিবিয়ায় গেল সপ্তাহেই পাচারচক্রের হাতে ২৬ বাংলাদেশি খুন হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আরও ১১ বাংলাদেশি। ২০১৯ সালের মে মাসেও লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি পাড়ি দিতে গিয়ে নৌডুবিতে অন্তত ৩৭ বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছিলেন। এত শত ঘটনার পরও প্রতিবছর হাজার হাজার নারী-পুরুষ একই পথে উন্নত জীবনের আশায় দেশ ছাড়ছেন। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানায়, ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে ইউরোপে প্রবেশকারীর সংখ্যায় বাংলাদেশিদের অবস্থান চতুর্থ।
এ ছাড়া যেসব দেশ রয়েছে সেগুলো হচ্ছে-গৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়া, নাইজেরিয়া, গায়ানা, আইভরি কোস্ট, মরক্কো, ইরাক, আলজেরিয়া, ইরিত্রিয়া ও গাম্বিয়া। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) তথ্যমতে, ইউরোপে এখন কাগজপত্রহীন অবস্থায় অর্থাৎ অবৈধভাবে বসবাস করছেন প্রায় এক লাখ বাংলাদেশি।
লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্য মতে, ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশটিতে পাঁচ হাজার বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত কয়েক মাসেই ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় আটক করা ৭০০ বাংলাদেশিকে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যানুযায়ী, লিবিয়া থেকে সাগরপথে পাড়ি দিতে প্রত্যেকে ৭০০ ডলার দেন দালালদের। ছোট ছোট নৌকায় করে অনিশ্চিত এ যাত্রায় সাগরে ডুবে কিংবা গাদাগাদির কারণে দম বন্ধ হয়ে প্রতিবছরেই হাজার হাজার লোক প্রাণ হারান। মূলত মানবপাচারকারীদের একটি চক্র তাদের অনেককে শুরুতে ঢাকা থেকে কয়েক মাসের ভ্রমণ ভিসায় লিবিয়ায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে সাগরপথে ইউরোপের দেশে পাঠানোর টোপ দেয়।
সংস্থাটি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ইউরোপ যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে ২০১৯ সালে মারা গেছেন কিংবা নিখোঁজ রয়েছেন ২ হাজার ৩৮ জন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যাটি ছিল ২ হাজার ২৯৯ এবং ২০১৭ সালে ৩ হাজার ১৩৯ জন। ২০১৮ সালে এভাবে ইউরোপে পাড়ি জমানো মানুষের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৪৪ হাজার ১৬৬ জন, ২০১৭ সালে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৬ এবং ২০১৬ সালে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৪৩৩ জন।
অবৈধপথে বিদেশযাত্রা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুুল মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশিদের অবৈধভাবে ইউরোপে পাচারের জন্য নিয়ে যাচ্ছে পাচারকারীরা। আর এভাবে যেতে গিয়ে অনেকে প্রাণও হারাচ্ছেন। দুঃখজনক হলো এসব পাচারকারীর অনেকেই আবার বাংলাদেশি। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান কঠোর।
এর আগে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবিতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ১৬ বাংলাদেশি আমাদের জানিয়েছিল এদেশের কারা পাচারের সঙ্গে জড়িত। কোন কোন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে তারা গিয়েছিল তাও জানিয়েছে। আমরা কিছু গ্রেপ্তারও করেছিলাম। এবারও যারা বেঁচে আছেন তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে দেশের পাচারকারীদের ধরা হবে।’ তবে সাধারণ মানুষকে পাচারকারীদের খপ্পরে পা না দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। সম্প্রতি লিবিয়ায় নিহতদের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এ বিষয়ে ক্ষতিপূরণের জন্য আমরা সে দেশের সরকারকে চিঠি দিয়েছি।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন