বরিশালে হু হু করে বাড়ছে করোনা শনাক্তের সংখ্যা। মাত্র ২০ দিনে বিভাগের ৬ জেলায় শনাক্ত হওয়া করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে ৩ গুণেরও বেশি। একই সঙ্গে বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও।
১২ এপ্রিল প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর প্রথম ৩৮ দিনে যেখানে পুরো বিভাগে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৬, সেখানে পরবর্তী ১১ দিনে তা বেড়ে ১০ জনে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হচ্ছে আক্রান্ত শনাক্তের প্রায় অর্ধেক মানুষই বরিশাল নগরীর। বিভাগের অন্যান্য এলাকার তুলনায় এখানে দৈনিক গড় হারে শনাক্তের সংখ্যাও বেশি।
এই অবস্থায় বরিশাল নগরীই হয়ে উঠছে করোনা সংক্রমণের কেন্দ্রস্থল। সাধারণের পাশাপাশি এখানে পুলিশ সদস্য ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরাও গণহারে আক্রান্ত হচ্ছেন করোনায়। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিভাগের ৬ জেলায় ১৫ জন চিকিৎসকসহ করোনা শনাক্ত হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের মোট ৫৫ জন কর্মীর।
একই সময়ে করোনা শনাক্ত হওয়া পুলিশ বিভাগের সদস্যদের মধ্যে কেবল বরিশাল জেলা এবং মেট্রোপলিটনেই রয়েছে ৫৬ জন। এদের মধ্যে ২ জন জেলা পুলিশের। এ ছাড়া পুলিশ পরিবারের সদস্য রয়েছেন ১৩ জন। সবকিছু মিলিয়ে ক্রমেই করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতা ক্রমেই বাড়ছে দক্ষিণে।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা মানুষের কারণেই বাড়ছে এই সংক্রমণ। তাছাড়া সংক্রমিত হওয়ার তুলনায় সুস্থ হয়ে ওঠার হারও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়।
বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিভাগের ৬ জেলায় সুস্থ হয়ে উঠা করোনা রোগীর সংখ্যা ১৩৪। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এভাবে সংক্রমণ ছড়াতে থাকলে চিকিৎসাসেবা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কারণ চিকিৎসক সংকটসহ করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত লজিস্টিক সাপোর্ট নেই বিভাগের ৬ জেলায়।
বরিশালে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় গত ১২ এপ্রিল। ওইদিন বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ ও মেহেন্দীগঞ্জে ২ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে মহামারীর তালিকায় নাম লেখায় বরিশাল। যদিও তখন বিষয়টি খুব একটা ভয়ের ছিল না।
করোনা শনাক্ত হওয়ার পরপরই বরিশালে ঢোকা এবং বের হওয়া নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি মোটামুটি অঘোষিত লকডাউন শুরু করে জেলা প্রশাসন। করোনা’র হাত থেকে মানুষ বাঁচাতে জেলা এবং মেট্রোপলিটন পুলিশও নেয় নানা উদ্যোগ। চেকপোস্ট বসানো হয় বরিশালে প্রবেশের সবগুলো পথে। নদী নিয়ন্ত্রণে নৌপথে টহল জোরদার করে নৌপুলিশ। এত চেষ্টার ফলে বেশ ভালোই থাকে বরিশাল। খুব গোপনে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা কিছু মানুষের কারণে সংক্রমণ খানিকটা ছড়ালেও তাতে শঙ্কার কিছু ছিল না।
ফলে প্রথম ২৮ দিনে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় করোনা শনাক্তের সংখ্যা থাকে ১৫৬। এ সময়ের মধ্যে বিভাগের ৬ জেলায় মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬। ১৫৬ জন আক্রান্ত হলেও একই সময়ে সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরে ৭৭ জন।
১০ মে থেকে সীমিত আকারে দোকান, মার্কেট এবং শপিং মলগুলো খুলে দেয় সরকার। এ ঘোষণার পর অগণিত মানুষের পদভারে প্রকম্পিত হয় বরিশালের ব্যস্ত বাণিজ্যিক এলাকাগুলো। অন্য জেলা-উপজেলাগুলোতেও সৃষ্টি হয় একই পরিস্থিতির। সেই সঙ্গে বাড়তে শুরু করে করোনা সংক্রমিত হওয়া শনাক্তের সংখ্যা।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে ১৮ মের মধ্যে বিভাগের প্রায় সবকটি জেলায় স্থানীয়ভাবে মার্কেট শপিংমলগুলো আবারও বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেন সংশ্লিষ্ট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা।
কিন্তু ততদিনে করোনা মোটামুটি জেঁকে বসেছে বরিশাল বিভাগের প্রায় সবকটি জেলায়। ১৮ মের হিসাব অনুযায়ী বরিশাল বিভাগে করোনা শনাক্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩৪। মৃত্যুর সংখ্যা না বাড়লেও মাত্র ৮ দিনে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যাওয়াকে অশনি সংকেত বলে উল্লেখ করেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
তারপরও দোকান-প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা এবং লকডাউন পরিস্থিতি কঠোর করায় কিছুটা হলেও হাফ ছেড়ে বাঁচে সাধারণ মানুষ।
১৮ মের পর কয়েকদিন সংক্রমণের হার নিম্নগামী থাকলেও পরিস্থিতি আবার খারাপ হতে শুরু করে ২৩ মে থেকে।
মূলত এর ১/২ দিন আগে শুরু হয় রাজধানী ঢাকা থেকে বরিশাল তথা দক্ষিণাঞ্চলমুখী মানুষের ঢল। সরকারের হাজার নিষেধ সত্ত্বেও ফেরি-ট্রাক এবং সর্বশেষ প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস বোঝাই হয়ে আসতে থাকে মানুষ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার বলেন, পত্র-পত্রিকা আর টেলিভিশনের খবরে প্লাবনের ঢেউয়ের মতো মানুষ আসতে দেখেই আমরা বুঝেছিলাম যে কপালে দুঃখ আছে। আর সেটাই হয়েছে। ২৩ তারিখের পর বিভাগের ৬ জেলা ও ৪২ উপজেলায় যারা করোনা শনাক্ত হয়েছেন তাদের প্রায় সবাই-ই হয় ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা নয়তো ওই সব এলাকা থেকে বরিশালে আসা মানুষের সংস্পর্শে থাকা।
এরপর যেন হু হু করে বাড়তে শুরু করে করোনা শনাক্তের সংখ্যা। ১৮ মে যেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২৩৪ মাত্র, ১০ দিনের ব্যবধানে ২৯ মে এসে তা দাঁড়ায় ৫০১ জনে। মৃত্যুর সংখ্যাও ৬ থেকে বেড়ে হয় ১০।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ১০ মে যেখানে পুরো বিভাগে ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৪ সেখানে ২৯ মে এসে দৈনিক আক্রান্তের গড় সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৩০।
১০ মে জেলাওয়ারী হিসাবে বরিশালে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫০, বরগুনায় ৩৮, পটুয়াখালীতে ৩০, ঝালকাঠিতে ১৪, পিরোজপুরে ১৯ এবং ভোলায় ৫; সেখানে ২৯ মে এসে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে বরিশালে ২৩০, বরগুনায় ৬৪, পটুয়াখালীতে ৫২, ঝালকাঠিতে ৪৯, পিরোজপুরে ৬৪ এবং ভোলায় ৪২।
শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, বরিশালে মহানগরে সংক্রমণের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। পুরো বিভাগে যেখানে করোনা শনাক্তের সংখ্যা ৫০১ সেখানে কেবল বরিশাল নগরেই সংক্রমিত শনাক্ত ১৭৬ জন।
বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মনোয়ার হোসেন বলেন, এভাবে সংক্রমণ বাড়তে থাকলে শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছি।
ডা. মনোয়ার হোসেনের এভাবে শঙ্কা প্রকাশেরও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কেননা বরিশাল বিভাগের ৬ জেলা ও ৪২ উপজেলায় চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্য কর্মীদের যতগুলো পদ রয়েছে তার বেশ বড় একটা অংশ দীর্ঘদিন ধরেই শূন্য। বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসকের ২২৪টি পদের মধ্যে ১২৯টিই শূন্য। নার্সসহ অন্যান্য সেবাকর্মীর ৫৫০ পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ১৫৯টি পদ।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় সহকারী পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, বরিশাল বিভাগের ৪২ উপজেলায় থাকা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ৬টি জেলা হাসপাতালে ১ হাজার ১৩১টি চিকিৎসক পদের মধ্যে বর্তমানে শূন্য রয়েছে ৪১৭টি। চলমান পরিস্থিতিতে যেভাবে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন তাতে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা মুশকিল।
কেবল চিকিৎসক সংকটই নয়, এখানে করোনা সংক্রমিত রোগীদের বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রশ্নেও রয়েছে সংকট। করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ বেড রয়েছে মাত্র ১২টি। হয়তো আরও ১০টি বেড বাড়ানো যেতে পারে। রোগীর সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে এই অবকাঠামো যে মোটেই প্রতুল নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালের পরিচালক বলেন, এটা ঠিক যে সম্পূর্ণ নতুন এই পরিস্থিতির জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। তবে এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। আমরা যেমন প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি, তেমনি তার মোকাবেলাও করছি। সরকারও আমাদেরকে যথেষ্ট সহযোগিতা দিচ্ছে। আশা করি সব সমস্যার মোকাবেলা করতে পারব আমরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন