তোলপাড় চলছে চারদিকে। হৈচৈ এর অন্ত নেই। এর পাশাপাশি ভয় আর শঙ্কা তো রয়েই গেছে। নর্থ সাউথ বিশ্ব বিদ্যালয়ের ট্রাস্টি, ক্যাম্পাস, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরাজ করছে অজানা আতঙ্ক । কে কখন কোন ঘটনায় ফেঁসে যায় এ নিয়ে চিন্তায় বিভোর অনেকেই। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ ৪ কর্মকর্তা ছাড়াও সম্প্রতি অবৈধ ভাবে নিয়োগ পাওয়া একজন সাবেক এয়ার কমোডরও রয়েছেন নানান শঙ্কায়। জানাগেছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বরখাস্ত হওয়া শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি তরিকুল ইসলাম মোমিন পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছে অনেক অজানা তথ্য দিয়েছেন।
এমনও তথ্য দিয়েছেন যা শুনলে রীতিমত বিস্মিত হবে যে কেউ। তরিকুল ১৬১ ধারায় পুলিশ, গোয়েন্দাদের ও রিমান্ড এবং ১৬৪ ধারায় আদালতে অনেক অজানা ও স্পর্শকাতর তথ্য দিয়েছেন। বলেছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২/৩ জন ট্রাস্টি কিভাবে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। তরিকুল আরো জানিয়েছে জমিকেনা, গবেষণার নাম করে অর্থ তছরুপ, ভর্তি বাণিজ্য, প্রবিশান বাণিজ্য ও নামে-বেনামে ভাউচার তৈরী করে অর্থ লোপাট এবং কোন কাজ কর্ম ছাড়াই লিগ্যাল এডভাইজার নিয়োগের নামে বছরে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার নানান দিক। নানান কলাকৌশল।
এসব বিষয় নিয়ে খোলামেলা ভাবে তরিকুল অসংগতি, দুর্নীতি ও লোপাটের নানান বিষয় নিয়েও কথা বলেছেন। তিনি পুলিশ ও গোয়েন্দাদের আরো জানিয়েছেন, একজন সিনিয়র ও প্রভাবশালী ট্রাস্টি তরিকুলের বাসাতে একজন সুন্দরী তরুণী নিয়ে সময় কাটিয়েছেন। এ নিয়ে খোদ ক্যাম্পাসে চলছে নানান কানাঘোষা। ওই ট্রাস্টির বিরুদ্ধে নারীঘটিত অনেক অভিযোগ নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই জানেন। তিনি চাকরী দিয়েও নানা স্ক্যান্ডাল ছড়িয়েছেন অনেকবার। বিষয়টি অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। তবে তরিকুলের বাসায় যে আপত্তিকর ঘটনাটি ঘটেছে সেই ঘটনাটির নেপথ্যের নায়ক তরিকুল নিজেই। তিনি সেই ফাঁদ পেতে এবং ওই তরুণীকে নিয়ে যাওয়ার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। জানা গেছে তরিকুল ওই ট্রাস্টিকে তার কব্জায় রাখতেই ওই পরিকল্পনা আটে। তবে অনেকেই বলেছেন ওই ট্রাস্টির এটা পুরানো স্বভাব। তিনি প্রায়ই এ জাতীয় নোংড়া কাজ করে থাকেন। তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ এখন গোয়েন্দাদের টেবিলে। দায়িত্বশীল সূত্র জানায় তরিকুল গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই ট্রাস্টি গোপনে দেশ ত্যাগ করেন। তিনি আগে থেকেই বিষয়টি আচ করতে পেরে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। জানা গেছে ওই প্রভাবশালী ব্যক্তি যে দেশে গেছেন তিনি সেই দেশের নাগরিকও বটে।
এডভোকেট শাহজাদী নাহিনা নুর:
এদিকে নর্থ সাউথে আলোচিত নারী হলেন, এডভোকেট শাহজাদী নাহিনা নুর। তিনি হালে আলোচিত-সমালোচিত। তিনি হলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লিগ্যাল এডভাইজার। সংশ্লিস্ট একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্যাম্পাসলাইভকে জানান, তিনি দেশে থাকেন না। বিদেশের মাটিতে থেকেও তিনি বাংলাদেশের একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গত প্রায় আড়াই বছর যাবত লিগ্যাল এডভাইজার হিসেবে চাকরী করেন। তাকে বোর্ড সম্মানি দেয় এক লাখ টাকা। জানা যায় একজন প্রভাবশালী ট্রাস্টি নিজস্ব প্রভাব খাটিয়ে তাকে লিগ্যাল এডভাইজার হিবেসে নিয়োগ দিয়েছেন। তবে নর্থ সাউথের অন্তত ৫/৬ ট্রাস্টি বলেছেন অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে তাকে লিগ্যাল এডভাইজার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। হিসাব শাখার সূত্রে জানা গেছে মাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে তিনি অনেকটা ধমকিয়ে তার সম্মানির টাকাটা তিনি নিয়ে যান। কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। এসব নানান বিষয়ে এডভোকেট শাহজাদী নাহিনা নুর এর সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। পরে তাকে ক্ষুধে বার্তা পাঠালেও তিনি কোন জবাব দেননি।
এডভোকেট শাহজাদী নাহিনা নুর নিজেই এটি শেযার করেছেন
নর্থ সাউথে কাজ করে একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শাহজাদী নাহিনা নুরের রয়েছে বিশাল দাপট। তিনি দেশে না থেকেও কোন উপদেশ না দিয়েও অন্যায় ভাবে মাসের পর মাস ধরে নিয়ে যাচ্ছেন তার সম্মানির টাকা। আরো জানা গেছে শাহজাদী নাহিনা নুর ছিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান প্রয়াত হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদের খুবই ঘনিষ্ট। তিনি জাতীয় পার্টিতে অনেক প্রভাব খাটাতেন। এরশাদ সাহেবের কাছ থেকে যে কোন কাজ আদায় করতে পারতেন তিনি। সংশ্লিস্টরা আরো জানান, নাহিনা নুর স্বত্তাধিকারী নুর এন্ড এসোসিয়েটস এর লায়ন ক্লাবের নেত্রী।
তিনি জেনভিও ফার্মা লিমিটেডের পরিচালক। একই সঙ্গে তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের লিগ্যাল এডভাইজার। আজিমপুরের অগ্রণী গার্লস স্কুল এন্ড কলেজে পড়াশুনা করেছেন। এলএলবি ও এলএলএম করেছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পরে তিনি নিউইয়র্কের সেন্ট জনস কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করেন। তবে তিনি অবস্থান করেন বা বসবাস করছেন মার্কিন মুল্লুকের (Leesburg) লেসবার্জ, ভার্জিনিয়াতে। জানা যায় তার স্বামীও জাতীয় পার্টি করেন। বর্তমানে তিনি চুপচাপ আছেন। নানান কারণে তিনি এখন কোনটাসা বলেও নর্থ সাউথ সূত্রে জানাগেছে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান প্রয়াত হোসাইন মুহাম্মদ এরশাদ ও শাহজাদী নাহিনা নুর
এদিকে তরিকুল আরো জানিয়েছে এক/দুইজন ট্রাস্টি তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এসাইনমেন্ট দিত। কখনও বৈধ আবার কখনও অবৈধ কাজ করাতো তাকে দিয়ে। এদিকে তরিকুল সূত্রে জানা যায় তাকে এনভার্নমেন্টাল সাইন্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট এ প্রফেসর জাকারিয়ার নাম আসছে ঘুরে ফিরে। তিনি নাকি তরিকুলের খুবই ঘনিষ্ট ছিলেন। তিনি বিভিন্ন গবেষণা কাজ করতেন নর্থ সাউথের। মোটা অংকের একটি ফান্ডও ছিল তার কাছে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানাগেছে ওই তছরুপ হয়েছে কি না তাও খতিয়ে দেখছেন তদন্ত কমিটি। কোটি টাকার উপরে ছিল সেই ফান্ড। এখন কতটাকা রয়েছে কত টাকা কোন খাতে খরচ হয়েছে এসবই তদন্তাধীন আছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই ৪ শীর্ষ ব্যক্তির ব্যাপারে নানান অসংগতি পাচ্ছে তদন্ত কমিটি।
প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ চারজনকে দিয়ে শুরু হলেও এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে। ওই শীর্ষ ব্যক্তিরা হলেন, সাবেক প্রো-ভিসি প্রফেসর জিইউ আহসান, প্রক্টর প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান খান, নির্বাহী পরিচালক ও প্রশাসনিক প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মাদ সাবের (অব) ও চীফ সিকিউরিটি অফিসার এম ইমরান। জানা যায় সাবেক দুই সেনা কর্মকর্তা ব্যাপারে নানান বিষয়ে নিয়ে আগে থেকেই শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের আপত্তি ছিল। এবার মন্ত্রনালয়ের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আর তাদেরকে করা হয়েছে সাসপেন্ড। একই সঙ্গে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে তাদের এট্রি ব্লক করে দেয়া হয়েছে। তাদের ব্যাপারে আপত্তিকর ও তরিকুল কানেকশনের তথ্যও মিলেছে।
আলোচিত সেই চারজন
আবদুস সালাম আজাদ কানেকশন:
তদন্ত সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, ছাত্রলীগ নেতা মুমিন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে এই কাজ করেছেন। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালের সাবেক কোষাধ্যক্ষ অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর এম আবদুস সালাম আজাদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে তরিকুল এই কাজ করেছেন কি না তা যাচাই করে দেখা হবে। প্রায়াজনে সংশ্লিষ্টদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খতিয়ে দেখা হবে। তবে এ বিষয়ে কোনো আর্থিক লেনদেনের কথা অস্বীকার করেছেন আবদুস সালাম আজাদ। ক্যাম্পাসলাইভকে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত বদলে দেওয়ার ঘটনায় তেজগাঁও থানায় যে মামলা হয়েছে সেখানে তার নাম আছে এটা তিনি শুনেছেন। প্রথমে তিনি দাবি করেন, এ মামলায় যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের কাউকে তিনি চেনেন না। এই ঘটনার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এক প্রশ্নের জবাবে আবদুস সালাম আজাদ স্বীকার করেন, তরিকুলের সাথে তার ফোনে দুই-একবার কথা হয়েছে। তরিকুল তাকে বলেছিলেন তারা বিভিন্ন জায়গায় কিছু কাজ করার চেষ্টা করেন। তার কাজটাও করতে চান।
তিনি আরো বলেন, তরিকুল নিজে থেকে যোগাযোগ করেছিল কিছু করে দেওয়ার জন্য। আমি তাকে নিষেধ করেছি। আর অর্থিক কোনো লেনদেন হয়নি। তবে তরিকুলের সঙ্গে পরিচয় কীভাবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট কিছু বলেননি আবদুস সালাম আজাদ। তিনি বলেন এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে আমি এর চাইতে বেশী কিছু বলতে চাইনা। জালিয়াতি করে তার নামের পাশে কেন টিক চিহ্ন দেওয়া হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তার একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যাও দিয়েছেন আবদুস সালাম আজাদ। তিনি বলেন, আমি ধারণা করছি, প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্ত বদলে দেওয়ার কাজটি যারা করেছে তারা অন্যদের বিপক্ষে করতে গিয়ে আমার পক্ষ নিয়ে ফেলেছে।
এদিকে নর্থ সাউথে নানান দুর্নীতি ও তরিকুল কানেকশনে অনেকেই ফেঁসে যেতে পারেন। এ ব্যাপারে বিওটিরও ২/১ জন তরিকুল কানেকশনে নানান অপকর্ম করে বেড়িয়েছেন। তাদেরকেও তদন্তে আনা হচ্ছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে। তবে গোয়েন্দারা বিভিন্ন তথ্য যাচাই-বাচাই করছেন। নজরদারিতে রেখেছেন বেশ কয়েকজন ট্রাস্টি ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শীর্ষ কয়েকজনকে। এসব নানান বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসি ক্যাম্পাসলাইভকে বলেন, আমরা নিয়ম ও বিভিন্ন বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত করছি। যা সত্য তাই করবো। কারো প্রতি আমরা অবিচার করতে চাইনা। তবে কেউ অন্যায় করলে ছাড় দেয়া হবে না বলেও তিনি জানিয়েছেন।
ক্যাম্পাসলাইভ২৪.কম
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন