সরকারের অনুমোদন না পাওয়ায় নিজেদের উদ্ভাবিত ‘জিআর র্যাপিড ডট ব্লট’ কিট দিয়ে করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরুর যে সিদ্ধান্ত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র নিয়েছিল ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের বাধার মুখে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হলো প্রতিষ্ঠানটিকে। মঙ্গলবার (২৬ মে) থেকে রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল ও সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে করোনা পরীক্ষা শুরুর ঘোষণা দিয়েছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। কিন্তু এখন আর সেই ট্রায়াল হচ্ছে না।
নিজেদের নেয়া সিদ্ধান্ত বিষয়ে গত শনিবার (২৩ মে) গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অনুমোদন তো আমাদের আছেই। তারা তো আমাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছে। আমাদের হাসপাতালকেও অনুমোদন দিয়েছে। সেটার বলেই আমরা করোনা ভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
তিনি জানিয়েছিলেন, মঙ্গলবার (২৬ মে) থেকে রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল ও সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে করোনা পরীক্ষা শুরু হবে। সবাই সেখানে গিয়ে পরীক্ষা করাতে পারবেন। এ পরীক্ষার জন্য ৭০০ টাকা করে নেয়া হবে। এর মধ্যে অ্যান্টিজেনের জন্য ৪০০ ও অ্যান্টিবডির জন্য ৩০০ টাকা।
কিন্তু এরইমধ্যে গতকাল ঈদের দিন সোমবার ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালকের পক্ষে সহকারী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলামের স্বাক্ষরিত করা চিঠিতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত জিআর কোভিড-১৯ র্যাপিড ডট ব্লট কিট দিয়ে কোভিড-১৯ শনাক্ত এবং এ কিট সরবরাহ ও বাজারজাত করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়। এরপরই নিজেদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র।
ওষুধ প্রশাসনের ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘গত ২৪ মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ পরিবেশিত হয় যে, ২৬ মে থেকে মেসার্স গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড তাদের উৎপাদিত জিআর কোভিড-১৯ র্যাপিড ডট ব্লট কিট ব্যবহার করে ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল ও সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু করতে যাচ্ছে।’
চিঠিতে বলা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) তাদের কিটের পারফরম্যান্স স্টাডি চলমান রয়েছে। এখন পর্যন্ত স্টাডি প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। প্রতিবেদন পাওয়ার পরেই কিটের রেজিস্ট্রেশন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত অনুনোমোদিত, কার্যকারিতা পরীক্ষাধীন থাকায় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিটচ করোনা শনাক্তকরণে ব্যবহার, সরবরাহ ও বাজারজাত থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হলো।’
এরপরই সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র জানায়, ‘ইন্টারনাল ভ্যালিডেশনের উদ্দেশ্যে ২৬ মে আমরা ৫০টি ‘জিআর কোভিড-১৯ র্যাপিড ডট ব্লট কিট’ পরীক্ষা করার প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের তরফ থেকে ২৫ মে চিঠি দিয়ে এ কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য বলা হয়েছে। সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারনাল ভ্যালিডেশন স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।’
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ‘দেশের বর্তমান জরুরি অবস্থা বিবেচনায় বিভিন্ন ওষুধ যেমন, রেমডেসিভিরের মতো ‘জরুরি ব্যবহার অনুমোদন’র আওতায় ‘ইন ভিট্রো ডায়াগনস্টিক কিট’ হিসাবে আমাদের এ কিটের অস্থায়ী অনুমোদনের আবেদন করছি। যেন অনুমোদন পেলে অবিলম্বে কিট প্রস্তুত শুরু করতে পারি।’
গত শনিবার (২৩ মে) ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘বিএসএমএমইউতে গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত কিটের সক্ষমতা যাচাইয়ে যে পরীক্ষা চলছে তাতে আমার মনে হয় না তারা ঈদের আগে সেটার ফলাফল দিতে পারবে। সেজন্য ঈদের পরে শুরু করছি আমাদের পরীক্ষাটা। আমরা আর অপেক্ষা করে বসে থাকতে পারি না।’
সরকার গণস্বাস্থ্যের কিটের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন না দেয়ার মধ্যেই পরীক্ষার সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ওইদিন বলেন, ‘হাসপাতালের প্যাথলজির পরীক্ষা কি সরকার বাধা দিতে পারবে? অনুমোদন হয়নি, সেটা তারা কোর্টে গিয়ে করবে। আমাদের হাসপাতাল তো ড্রাগের (ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর) অধীনে না। তারা নথি দিলে সরকারকে উত্তর দেবো। আমাদের কাছে বিএসএমএমইউ-এর অনুমোদন আছে।’
গত ৩০ এপ্রিল ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) অথবা আইসিডিডিআরবিতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য অনুমতি দেয়া হয়। এরপর গত ২ মে কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য বিএসএমএমইউ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শাহীনা তাবাসসুমকে প্রধান করে ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীলের নেতৃত্বে এই কিট উদ্ভাবন করেছেন একদল বিজ্ঞানী। অন্য গবেষকরা হলেন–ড. ফিরোজ আহমেদ, ড. নিহাদ আদনান, ড. মো. রাইদ জমিরুদ্দিন ও ড. মুহিব উল্লাহ খোন্দকার।
কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষকে চাহিদা মোতাবেক ২০০ কিট গত ১৩ মে পৌঁছে দেয় গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। এর একদিন আগেই ১২ মে কিট চেয়ে গণস্বাস্থ্যকে চিঠি দেয় বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ।
ওইদিন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চিঠি মোতাবেক আমরা তাদের হাতে ২০০ কিট পৌঁছে দিয়েছি। আমাদের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বিজন কুমার শীল ও মহিবুল্লাহ খন্দকার এ কিট পৌঁছে দিয়েছেন। এছাড়ও কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষার খরচ বাবদ ৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে।’
এরইমধ্যেও ১১ মে এক সংবাদ সম্মেলনে কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের গবেষকদের উদ্ভাবিত করোনা ভাইরাস শনাক্তকরণ কিট বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করে দেশবাসীর কাছে নিজেদের প্রতিষ্ঠানের অপারগতার জন্য ক্ষমা চান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। একইসঙ্গে তিনি নিজেদের তৈরি ‘জিআর র্যাপিড ডট ব্লট’ কিট দিয়ে করোনা ভাইরাস পরীক্ষা করার জন্য সরকারকে সাময়িক সনদপত্র দেয়ার আহ্বান জানান। এর একদিন পরই গত ১২ মে কিট দেয়া ও ব্যাংকে খরচ বাবদ নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে চিঠি দেয় বিএসএমএমইউ।
ব্রেকিংনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন